আব্দুল্লাহ অপু
বাটা সু ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের মধ্যে সকাল থেকেই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। গতরাতের মিলিটারি অপারেশনে তছনছ হয়ে গেছে ঢাকা শহর। শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করে কোথায় রাখা হয়েছে তার কোন খবর নাই, তিনি জীবিত আছেন কিনা সেটাও বাঙালিরা জানেনা। টঙ্গী ব্রীজের আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র আতংক। ব্রীজের এক কোনায় দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া এক বীর সৈনিক। বছর খানেক আগে তিনি বাটার প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন। গত রাতে অপারেশন সার্চ লাইট তিনি নিজ চোখে দেখেছেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে। ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আগামী দিনগুলোর ভয়াবহতা নিয়ে ভাবছেন উইলিয়াম ওডারল্যান্ড আর একমনে সিগারেট টানছেন। স্ত্রী মারিয়াকে তিনি আজ রাতেই চিঠি লিখবেন ঠিক করেছেন। কী লিখবেন এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেন নি, শুধু তাঁর মাথায় একটা লাইনই ঘুরছে- "Big revenge! I will take a big revenge on behalf of my Bengali brothers."৫ মার্চ সকাল বেলার ঘটনা আবার মনে পড়ে যায় ওডারল্যান্ড সাহেবের। বাটা সু ফ্যাক্টরির অদূরেই মেঘনা টেক্সটাইল মিল। তিনি দুপুরে খাওয়ার পর যে ঘরটাতে ইজি চেয়ারে শুয়ে বিশ্রাম নেন সেখান থেকে পরিস্কার দেখা যায় মেঘনার মেইন গেট। সহকর্মী আব্দুল মালেক সেদিন বাসা থেকে খাবার এনেছিলেন ওডারল্যান্ড সাহেবের জন্য। বাঙালিয়ানা খাবার। আমন ধানের ভাত, টমেটো দিয়ে শোল মাছের ঝোল, কলা ভর্তা, বাঁধাকপির বড়া, মসুরের ডাল। ওডারল্যান্ড তৃপ্তি সহকারে ভরপেট খেয়েছেন, বলা চলে তিনি তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ কাজটাই করেছেন। ভারী খাবার তিনি খান না বললেই চলে। সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এমন সময় গুলির শব্দ শোনা যায়। ভ্রু কুচকে তিনি তাকিয়ে থাকেন সহকর্মী মালেক সাহেবের দিকে।
কী হচ্ছে মালেক? গুলির শব্দ কেন?
স্যার, কিছুই বুঝতে পারছিনা। খবর নিয়ে জানাচ্ছি। জবাব দেন মালেক সাহেব।
'তোমার খবর নিয়ে কাজ নেই, আমি দেখছি' বলেই ওডারল্যান্ড সাহেব জানালার বাইরে তাকান। কী বিভৎস দৃশ্য! মিলের গেটের সামনে শ্রমিকদের গুলি করে মারা হচ্ছে। দিনের আলোতে এভাবে মিলিটারিরা নিজ দেশের মানুষকে মারতে পারে, কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না ওডারল্যান্ডের। তাঁর স্মৃতিপটে ভেসে উঠে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা, মনে পড়ে যায় হল্যান্ডের জনগনের উপর জার্মান নাৎসি বাহিনীর সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের কথা।
৫ মার্চের দুঃসহ স্মৃতির ক্ষত সারতে না সারতেই ওডারল্যান্ড সাহেবের সামনে ঘটে গেল ২৫ মার্চ কালো রাতের গণহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি ভেবেছিলেন পৃথিবীতে মানুষে মানুষে হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহ কমে যাবে, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অমানবিক আচরণ, হিরোশিমা নাগাসাকি শহরের চরম মানবিক বিপর্যয় থেকে বিশ্বনেতারা কিছুটা হলেও শিক্ষা নিবেন। হায় আফসোস! মানুষ কিছুই শিখল না। ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীন হলো পাকিস্তান। কত স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করল এ অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠী! খুনাখুনি, মারামারি, মেয়েদের সম্ভ্রম হানি, জ্বালাও পোড়াও এর মধ্যে শতশত বছরের পুরোনো আবাসস্থল ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো ভারত পাকিস্তানের মানুষ। অথচ দেশ স্বাধীনের বিশ বছরের মাথায় এসে বাঙালি মুসলমানেরা বুঝল ৪৭' এর দেশভাগের ফর্মুলা কতটা অপরিপক্ক ছিল! ১২০০ মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তান ভাই হয়ে থাকতে পারেননি কখনো, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির কাছে তারা কেবল প্রভুত্ব দেখিয়েই গেছে। হায়রে মুসলমান ভাই!
ওডারল্যান্ড সাহেব বহুবার পাকিস্তান আর্মির বড় বড় অফিসারদের সাথে আলাপ করেছেন, টেবিল টেনিস খেলেছেন, হুইস্কি খেয়েছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছেন। বাটা কোম্পানির মিলিটারি বুটের দারুণ কদর ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে আর সেই সুবাদেই তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল ক্যান্টনমেন্টে। বাঙালিদের ব্যাপারে পাকিস্তান আর্মির মনোভাব কখনই ইতিবাচক মনে হয় নি ওডারল্যান্ড সাহেবের কাছে। ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে জেনারেল পর্যন্ত প্রায় সবাই নিজেদেরকে অভিজাত শ্রেণীর মনে করতেন আর বাঙালিদের তাঁরা মানুষ বলেই গণ্য করতেন না। ৭০' এর নির্বাচনে আওয়ামিলীগের নিরংকুশ বিজয় দেখে ওডারল্যান্ড সাহেব বলেছিলেন সহকর্মী মালেক সাহেবকে, 'এবার সময় এসেছে! বাঙালির ন্যায্য দাবী দাওয়া কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেয়ার সময় এসে গেছে'।
টঙ্গী ব্রীজের কাছে এসে দাঁড়ান মালেক সাহেব। তাঁর চোখেমুখে ফ্যাকাসে ভাব, চুল উস্কোখুস্কো, গায়ে ফুলহাতা যে শার্ট পরেছেন সেটার ডান হাতে বোতাম লাগানো আছে আর বাম হাতা গোটানো। সর্বক্ষণ পরিপাটি থাকা মানুষটার এই বিঃধস্ত চেহারা যেন কোন ব্যক্তি মালেকের চেহারা নয়, এটা খোদ পূর্ব পাকিস্তানেরই চেহারা! ওডারল্যান্ড সাহেব অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি আঁচ করতে পারেন, মালেক সাহেবের উপর ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেছে নিশ্চয়ই। সহকর্মীর দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে আলাপ শুরু করেন ওডারল্যান্ড।
What happened brother?
Exhausted sir, everything exhausted.
আমার ছোট ভাইটার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা স্যার। সে ইকবাল হলে থাকত। মিলিটারি অপারেশনে বহু ছাত্র মারা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মালেক সাহেবকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পান না মিঃ ওডারল্যান্ড। তাঁর সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যখন হত্যাযজ্ঞ চালায় আমস্টারডাম শহরের নিরীহ মানুষের উপর তখন তিনিও ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলেন। কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, কিভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে কিছুই ঠিক করতে পারেন নি ওডারল্যান্ড সাহেব। শুরুর কয়েকটা দিন বলা চলে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য ছিলেন। যুদ্ধ করতে করতে একবার তিনি ধরা পড়ে যান নাৎসি বাহিনীর হাতে। মৃত্যু অনিবার্য ধরে নিয়েই ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে থাকেন তিনি, যেভাবেই হোক এই বর্বর বাহিনীর হাত থেকে বেরোতেই হবে। জার্মান ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন তিনি। বন্দীদশা থেকে পালাতে এবং পরবর্তীতে গুপ্তচরবৃত্তিতে ওডারল্যান্ড সাহেবের জন্য যথেষ্ট সহায়ক ছিল তাঁর জার্মান ভাষার দক্ষতা।
হিটলারের নৃশংসতার সাথে পাকিস্তানি মিলিটারির গণহত্যার অদ্ভুত মিলে খুঁজে পান ওডারল্যান্ড। পৃথিবীর সব দেশের সব নিষ্ঠুর লোকেদের চরিত্রই মনে হয় একইরকম। সহকর্মী মালেকের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত হতে থাকে এই ডাচ অস্ট্রেলিয়ান মানুষটার। দৃঢ়ভাবে তিনি বলতে থাকেন-
'Big revenge, Big revenge to be backed against genocide.'
ঢাকা,বাংলাদেশ
0 মন্তব্যসমূহ