সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে: ৮ম পর্ব

                                      

ড. গৌতম সরকার


এখানে নদীটার নাম তরুণী। আশপাশের পাঁচটা গ্রামকে জলদান করে। এই অঞ্চলে পুকুর, খাল-বিলের সংখ্যা নেহাতই কম। নোনামাটির এই দেশে চাষবাসও সেভাবে হয়না, ওই কিছু সব্জি ফলে আর বছরে একটা ধান, তাও ফলন খুব কম। বালি মাটি জল ধরে রাখতে পারেনা, তাই ফসল শুকিয়ে যায়, দুধের থেকে ছিবড়ে জমে বেশি। এখানকার মানুষগুলো সব বেআইনিভাবে বর্ডার পেরিয়ে এপারে এসে বসতি গড়েছে। প্রশাসন থেকে বহুবার উছ্বেদের হুমকি দিলেও ভোটের কথা মাথায় রেখে সেসব মৌখিক হুমকিই থেকে গেছে, কার্যে পরিণত হয়নি। পরিবারের পুরুষেরা হয় জমিতে কাজ করে, নয় মাছ ধরে। মাঝে মাঝে একেকজন যুবক কাজের সন্ধানে গাঁ ছেড়ে কোন কোন মুলুকে পাড়ি দেয়। বছরের পর বছর ঘুরে যায়, একআধটা চিঠি, মাঝে মাঝে দু-পাঁচশো টাকা মানিওর্ডার আসে। বহু বাবা-মায়ের জীবদ্দশায় ছেলের মুখ দেখা আর হয়ে ওঠে না। আবার কখনও কখনও, যদিও এঘটনা গাঁয়ে দুয়েকবারই ঘটেছে, কোনো বাড়ির ছেলে দীর্ঘকাল বাদে বিদেশ থেকে একেবারে ছেলেবউ শুদ্ধ আচম্বিতে এসে হাজির হয়েছে। সেইসব সময়ে এই আপাত নিথর গ্রাম খবরের চমকানিতে উথাল পাথাল হয়ে ওঠে। বাড়ির লোকেদের মান-অভিমান-রাগ-কান্না পেরিয়ে আধবুড়ো বউকে ছেলেপুলে সমেত বরণ করে ঘরে তোলা হয়, গোটা গ্রাম তার সাক্ষী থাকে। এইরকম এক সময়ে কাউকে না জানিয়ে গোঁসাইবাড়ির এক ছেলে বাড়ি ছেড়ে পালাল। এপাড়ায় গোঁসাইবাড়ি ছিল একমাত্র ব্রাহ্মণ পরিবার। শ্রীপতি গোঁসাইরা ছিলেন তিন ভাই, সারা গ্রামের পূজার্চনা ছাড়া কয়েক বিঘে জমিও ছিল। নদীর উত্তর ধারে মাটির দোতলা বাড়ি। মা তখনো বেঁচে, শ্রীপতির বিয়ে হল পাঁচটা গ্রাম পরে হরিদাস বৈরাগীর মেয়ে লক্ষীরানীর সঙ্গে। পরে আস্তে আস্তে শ্রীপতি পরের দুই ভাইয়েরও সংসার বসিয়ে দিলেন। তারপর মা চোখ বুজল, আর যা হয় ভায়ে-ভায়ে, ভাইয়ের বৌদের মধ্যে কোন্দল শুরু হল। অবশেষে গাঁয়ের বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শে তিনভাই ভিন্ন হল। আর আলাদা হওয়ার পরেই এতদিনকার মোটা ভাত-মোটা কাপড়ের সংসারে অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিল। শ্রীপতির এক ছেলে, কিন্তু ছোট থেকেই খুব রুগ্ন। আর পাঁচটা বাচ্চার মত প্রাণশক্তি নেই। খেলেনা, দৌড়াদৌড়ি করেনা। ওর বয়সী ছেলেরা যখন সারা মাঠ জুড়ে দাপিয়ে ফুটবল খেলে, নদীর জলে লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে এপার-ওপার করে ও তখন চুপ করে বসে শুধু দেখে যায়। শ্রীপতি পরিবারের তিনটে মানুষ আর দুটো গরুর মুখে খাবার যোগাতে সকাল-সন্ধ্যা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলে, ছেলের কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ পায়না। সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে খেয়েদেয়ে একদলা আফিম মুখে ফেলে ঝিমোতে থাকে। লক্ষীরানী গজগজ করলেও মানুষটাকে দোষ দিতে পারেনা। সে নিজে যেখানে পারে সেখানেই ছেলেকে নিয়ে ছুটে যায়, সে কবিরাজই হোক, বা হেকিম, ফকির, কি শ্মশান কালীর ভৈরব-ভৈরবিনী, বা তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, কিছুই সে বাকি রাখেনি। ছেলে বড় হতে লাগল, বুদ্ধি পাকতে থাকলেও শরীরে গত্তি লাগলনা। সারাবছর কোনো না কোনো রোগে ভুগেই চলে, বিশেষ করে বর্ষায় আর শীতে যখন হাঁফানির টান উঠত, তখন লক্ষীরানীর কতবার মনে হয়েছে, আর বুঝি বাছাকে ধরে রাখতে পারলোনা। সেই ছেলে পনের বছর বয়সে ঘর ছেড়ে পালাল।

    শ্রীপতি আর লক্ষীরানীর ওই একটাই সন্তান। ছেলে চলে যাওয়ার পর দুজনের জীবনযাত্রা প্রবলভাবে ধাক্কা খেল। শ্রীপতির মনে হল, আর কার জন্য সে দিনরাত মাথার ঘাম ঝরাবে, আর লক্ষীরানীর জীবনটা এমনভাবে ছেলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ছিল যে তার নিজের কাছে নিজের আলাদা কোনো অস্তিত্ব ছিলনা, তাই ছেলে চলে যাওয়ার পর কিরকম একটা শূন্য, নিরাকার অনুভব হতে লাগল। এরপর তারা শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই বেঁচে রইল। পাড়ার লোকজন, ভাই-ভাইবৌরা কদিন আসা-যাওয়া করল, আহা-উহু করল, পলাতক ছেলের উদ্দেশ্যে নিন্দে-মন্দও করল, তারপর সব ভুলে গেল। দুটো মানুষ দিনগত পাপক্ষয় করতে করতে ভূতের মত বাড়িটায় বাস করতে লাগল।

      কোনো পরিকল্পনা ছিলনা। একদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠে ছেলেটা দেখল একটা অন্যরকম আলোয় পৃথিবী মাখামাখি হয়ে আছে। ওর মধ্যে একটা অনুভব এল, তার যাওয়ার সময় হয়েছে। কোনো প্রস্তুতি ছিলোনা, পরিকল্পনাও নয়, কিন্তু ওই অদ্ভুত রঙে ধোওয়া সকাল, আকাশ, ঘাস-পাতা, উঠোন-দুয়ার, এমনকি কালি গাইয়ের হাম্বা ডাকের মধ্যে বেরিয়ে পড়ার আজান গান  কানের মধ্যে বেদমন্ত্র হয়ে বাজতে লাগল। সে বেরিয়ে পড়ল। তারপর সবকিছু খুব স্পষ্ট নয়, ঘুরতে ঘুরতে, থামতে থামতে, বাস, গাড়ি, ট্রেন চড়তে চড়তে ছেলেটা একদিন তার গ্রামের তরুণী নদীর তুলনায় আড়ে-বহরে অনেক বড় এক নদীর কাছে পৌঁছল। এটা কি তাদের সেই মিষ্টি, ছোট্ট, বালিকা ‘তরুণী’ নদী যৌবনপ্রাপ্তা হয়ে শরীরের চড়াই-উৎরাইয়ের দিগন্তে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে! নাকি এটাই সমুদ্র!

  নদীর ধারে খোলা আকাশের নিচে দুদিন অর্ধভুক্ত কাটানোর পর এক সকালে ছেলেটি একজন ব্যক্তির চোখে পড়ে গেল। ভদ্রলোককে সে আগের সন্ধ্যায় সিঁড়ির অন্যপ্রান্তে বসে ভাগবত পাঠ করতে দেখেছে, তাঁর সামনে সাদা কাপড় পরিহিতা বহু বয়স্কা মহিলা চুপ করে শুনছিল। গ্রামে বাবাকে অনেকের বাড়িতে ভাগবত পাঠ করতে শুনেছে। সেই ভদ্রলোক সকালে গঙ্গাস্নান করতে এসে তাকে দেখে কিছু একটা বুঝেছেন। এগিয়ে যেতে গিয়েও দু পা পিছিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, "এ খোকা, তুমহারা ঘর কাঁহা?" প্রশ্নটা বুঝতে পারলেও এই ভাষায় উত্তর দেওয়ার সাধ্য ছেলেটির নেই। তাই কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল। ভদ্রলোক গভীরভাবে অভিজ্ঞতার চোখে পর্যবেক্ষণ করে যা বোঝার বুঝে গেলেন। এবার কন্ঠস্বরে আরও স্নেহ মাখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি বাঙালি? কোন টোলায় থাকো? বাবার নাম কী?" ওনার মুখেই শুনলেন জায়গাটির নাম বেনারস আর চোখের সামনে বিস্তৃত অনন্ত জলরাশি হল মা গঙ্গা। একথা শুনে অজান্তেই তার দুটো হাত কপালে উঠে এল আর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির মাথায় মা-গঙ্গা কৃপা বর্ষণ করলেন৷

   বেনারসে এই অঞ্চলটার নাম খালাসিটোলা, মা গঙ্গা হাঁটাপথ। তার ব্রাহ্মণ পরিচয় জেনে নিজের বাড়িতে রেখে উনি সংস্কৃত শিক্ষা দিতে লাগলেন। বাড়িতে ভদ্রলোক ছাড়া আছে মা-মরা মেয়ে কুন্তী। বয়সে ছেলেটির তুলনায় বছর চারেকের ছোট হবে। কুন্তীই এবাড়ির কর্ত্রী। গোপালবাবু তাঁর শিক্ষার ভার নিলে, বাকি সমস্ত কিছুর ভার চলে গেল কুন্তীর দখলে। বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ে, মাঝে মাঝে গঙ্গার ঘাটে অন্ধকারের মধ্যে বসে চোখের জল ফেলে, কিন্তু কখনোই গ্রাম ছেড়ে, বাবা-মাকে ছেড়ে আসার জন্য নিজেকে দোষারোপ করেনা। তার সবসময় মনে হয়, সে কোনো এক দৈব নির্দেশ মেনে চলছে। সেদিনকার সকালের সেই অদ্ভুত আলো, তার রঙ, রূপ, ইশারা আর কখনও টের পায়নি, তাহলে সেটা সংকেত ছাড়া আর কি! এই যে বিদেশ-বিভূঁইয়ে এক অনাত্মীয় পরিবার তাকে নিজের ছেলের মত লালন করছে, সেটা কার নির্দেশে! ছেলেটা বেশি ভাবতে পারেনা। তার অশক্ত শরীরের সাথে সঙ্গতি রেখে চিন্তাশক্তিও খুব দূর্বল। বেশি ভাবলে মাথার ভিতর দপদপ করে যন্ত্রণা হয়। ছেলেটি ভদ্রলোককে মাস্টারমশাই বলে ডাকে। প্রথমদিন পড়তে পড়তেই মাথার অসহ্য যন্ত্রনায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। তারপর ভদ্রলোক ধীরে ধীরে তার মুখ থেকে শরীরের যাবতীয় সমস্যার কথা শুনলেন। স্থানীয় এক অবাঙালি কবিরাজকে দেখিয়ে দাওয়াই নিয়ে এলেন৷ বিভিন্ন জড়ি-বুটি, গাছের ছাল, মূল, পাতা মিশিয়ে সেই দাওয়াই এখন মাস্টারমশাই নিজেই প্রস্তুত করেন। কিছুদিনের মধ্যেই শরীরের কষ্ট অনেক কমে গেল। আর শরীরের কষ্ট যত কমতে লাগল, তার সংস্কৃত শিক্ষা তরতর করে এগোতে লাগল।  শিক্ষাদানের সাথে মাস্টারমশাই তাকে সঙ্গে করে ভাগবত পাঠের আসরে নিয়ে যেতে লাগলেন। ছেলেটি মন দিয়ে শুনত, সারা পাঠ জুড়ে কখনও ভেসে যাওয়া, কখনও ডুবে যাওয়া, আবার ভেসে ওঠা আকুতিগুলো বৃদ্ধ মানুষটির কণ্ঠের ওঠাপড়ায় এতটা বাস্তব হয়ে উঠত যে ছেলেটি দিশা হারিয়ে নিঃসঙ্গ নাবিকের মত একটা ছোট্ট নৌকায় চড়ে আকুল দরিয়ায় ভেসে যেত। একদিকে মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষার শাসন, অন্যদিকে কুন্তীর জীবনাচরণের শিক্ষার মধ্যে ছেলেটি আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ল। কিন্তু কখনো হাঁফিয়ে উঠলোনা, বরঞ্চ বেশ উপভোগ করতে লাগল। বিশেষ করে কুন্তীর খাওয়া-পড়া-নিদ্রা-জাগরণে চাপিয়ে দেওয়া শাসনের মধ্যে আন্তরিকতা ছাড়িয়ে বিশেষ কিছু একটার সন্ধান পেতে লাগল, যেটা তার কিশোর মনকে এক মেঘলা ভাঙা আকাশের সামনে দাঁড় করিয়ে দিত।

   তবে সুখের দিন চিরস্থায়ী হয় না। দুদিনের জ্বরে মাস্টারমশাই সেই সুদূর শহরে চোখ বুজলেন। আর তার সঙ্গে দীর্ঘ এক সংগ্রামের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটল। এরমধ্যে ছেলেটি তার ভবিষ্যৎ পড়ে ফেলেছিল। ছোটবেলা থেকে কোনদিনই সে স্বাবলম্বী হতে পারেনি। আজ বাইশ বছর বয়সে পৌঁছেও সে একইরকম পরনির্ভরশীল রয়ে গেছে। এসব জায়গায় একটাই সুবিধা হল একই বাড়িতে একজন যুবতী মেয়ের সাথে অনাত্মীয় এক যুবকের থাকা নিয়ে গাঁ-গঞ্জের মত কানাকানি হয়না। পরন্তু মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর এলাকার বয়স্ক কিছুর মানুষ এসে তাদের বিয়ে করার পরামর্শ দিলেন। বাৎসরিক কাজটা ছমাসে মিটিয়ে তাদের বিয়ে হল। তারপর শুরু হল আবার একটা জীবন সংগ্রামের কাহিনী। ভাগবত পাঠ এবং টুকটাক পুজোআর্চা করে সংসার চলেনা, মাস্টারমশাই কিভাবে চালাতেন ভগবান জানেন। তাছাড়া ছেলেটি শারীরিকভাবে কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারলো না। আর সেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতাই সারাজীবন সুখের পথে কাঁটা হয়ে রইল। কুন্তীকে বাধ্য হয়ে ওই অল্পবয়স থেকেই সংসারের হাল ধরা শুরু করতে হয়েছিল, আর সেই হাল সে আজও ধরে আছে। হাতবদল করার কোনো সুযোগই জীবনে পেলনা, কারণ আমি তো চিরকালই হালভাঙা নাবিকের মত ওর বোঝা হয়েই রয়ে গেলাম।

  কামরার মধ্যে হঠাৎ করে শব্দের নৈঃশব্দতা নেমে এল, চারপাশের এত শব্দ কোন শক্তিশালী চুম্বক শুষে নিচ্ছে বোধগম্য হলনা। কথা শেষ করে ভদ্রলোক পিছন ফিরে শুলেন, যেন বস্তুমাত্রিক জগতের সাথে ওনার আর কোনো লেনাদেনা নেই। মাসিমা এখনও ফেরেননি। ঘোর কেটে গেল কতকগুলো কচিকাঁচার আনন্দ চিৎকারে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম শরতের নীল আকাশ থেকে কতকগুলি দুষ্টু সাদা মেঘ কামরার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তারা সবাই আকাশের সামনে বসে দুলে দুলে কবিতা মুখস্থ করছে, 

 

"আমলকি বন কাঁপে যেন তার

বুক করে দুরু দুরু-

পেয়েছে খবর পাতা-খসানোর 

সময় হয়েছে শুরু।

 

শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এল,

টগর ফুটিল মেলা,

মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায়

মৌমাছি দুই বেলা।

.............................................

..............................................

এসেছে শরৎ, হিমের পরশ

লেগেছে হাওয়ার পরে,-

সকাল বেলায় ঘাসের আগায়

শিশিরের রেখা ধরে।"

চোখ গেল আকাশের পাশে বসা মেয়েটির দিকে। সেও বাচ্ছাদের পড়া দেখিয়ে দিচ্ছে। আকাশেরই বয়সী, মিষ্টি দেখতে মেয়েটিকে আগে কখনও দেখেছি বলে খেয়াল করতে পারলাম না।

                                                                       (ক্রমশঃ....)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ