সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী - "আশ্চর্য প্রদীপ"


তানভীর আহমেদ সৃজন

২৩ জুন, ২০১৮
রাত ৯:০০ টা
“চা চলবে ডক্টর ত্রিভূবন রায়?”
অবাক হয়ে সামনের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসা লোকটির দিকে তাকালেন ডক্টর ত্রিভূবন রায়। তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে, তাকে অপহরণ করে এনে হাত পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রেখে আবার জিজ্ঞেস করছে চা চলবে কিনা?!
“আমাকে তোমরা এখানে কিডন্যাপ করে এনেছো কি চা খাওয়ানোর জন্য?” ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর ত্রিভূবন।
“না, ঠিক তা নয়।” খানিকটা নড়েচড়ে বসতে বসতে লোকটি বলল, “আপনাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে নিরিবিলি পরিবেশে আপনার সাথে একটা ডিল করার জন্যে। তাই ভাবলাম চা খেতে খেতেই ডিলটা সেরে ফেলা যাক!”
“ডিল?” অবাক হওয়ার ভান করে বললেন ডক্টর ত্রিভূবন, “কীসের ডিল?”
“আপনি নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টরের যেই ডিজাইনটা তৈরি করেছেন,” লোকটি বলতে লাগলো, “সেটা আমাদের বসের চাই। বস একটা বিদেশী পার্টির কাছে অনেক বড় অংকের টাকা পেয়েছেন ডিজাইনটা তাদের কাছে হ্যান্ডওভার করার জন্য। আর আজকে যদি আপনি ডিজাইনটা আমাদের কাছে হ্যান্ডওভার করেন, তাহলে সেই টাকার থার্টি পারসেন্ট আপনার।”
লোকটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ডক্টর ত্রিভূবন। তারপর অত্যন্ত শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আর যদি হ্যান্ডওভার না করি?”
“তাহলে কী আর করা?” কোমরে গোঁজা রিভলভারটা বের করতে করতে শীতল গলায় বলল লোকটি, “আপনার আশা বাদ দিয়ে আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে ডিজাইনটা আপনি কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন!”
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর ত্রিভূবন। তারপর ধীরে ধীরে তার মুখে একটা বিচিত্র হাসির রেখা ফুটে উঠলো। এক পর্যায়ে লোকটিকে অবাক করে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি।
“একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে তুমি আর কী মারবে বদি?”
লোকটি চমকে উঠলো ডক্টর  ত্রিভূবনের মুখে নিজের নাম শুনে। ডক্টর ত্রিভূবনের তো তার নাম জানার কথা না! তাহলে তিনি কীভাবে জানলেন?
“ভাবছো, আমি তোমার নাম কীভাবে জানলাম? আমি তো তোমার সাগরেদ জহিরের নামও জানি, যাকে সঙ্গে নিয়ে তুমি এক মাস ধরে আমাকে ফলো করছো।” মুচকি হেসে বললেন ত্রিভূবন রায়। বদি খেয়াল করল, ভদ্রলোকের গলার স্বর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে। তার চোখও যেন বার বার বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে, তিনি জোর করে তার চোখ জোড়া মেলে রেখেছেন।
“তোমাদের কী ধারণা, তোমরা আমাকে এখানে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছো?” গলা যেন আরো বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে ডক্টর ত্রিভূবনের। তিনি বললেন, “তোমাদের ধারণা ভুল। আমিই তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, আমার ইনফর্মার মারফত তোমাদের আমাকে কিডন্যাপ করতে আসার খবর শোনার পর থেকে!”
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে বদি তাকিয়ে রইলো ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের দিকে। তিনি বলে যেতে লাগলেন, “আমি এখানে এসেছি মৃত্যুর আগে শুধু একটা কথা জানতে। কে তোমাদের বস? আর এত কনফিডেনশিয়াল একটা প্রজেক্টের কথা সে কী করে জানলো?”
কথা শেষ করে সারতে পারলেন না ডক্টর ত্রিভূবন রায়, হঠাৎ-ই যেন খিচুনি শুরু হল তার। বদি ছুটে এসে তার কলার চেপে ধরে হিস হিস করে বলল, “জলদি বলুন! ডিজাইনটা কোথায়?!”
“প্রদীপের দৈত্যের কাছে!” ম্লান হেসে বললেন ডক্টর ত্রিভূবন রায়। তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তবুও তিনি বলতে লাগলেন, “কিন্তু দৈত্য তোমাদেরকে ওটা দেবে না। সে ওটা তার সেই প্রভুকেই দেবে, যে তার কাছে আগে পৌঁছাবে! আর তার প্রভুকে ঘায়েল করে যদি তোমরা ওটা হাতিয়েও নাও...”
ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের কথা শেষ হবার আগেই তার গালে কষে একটা চড় মারল বদি। দাঁত মুখ খিচিয়ে সে বলল, “আমার সাথে রংবাজি করিস?! তোকে জানে মেরে ফেলব হারামজাদা!”
ডক্টর ত্রিভূবনের মুখের হাসিটা আরো চওড়া হল। দূর্বল গলায় তিনি বললেন, “আমাকে তোমরা কী মারবে? বরং তোমরা যাতে অত্যাচার করে আমার মুখ থেকে কথা আদায় করতে না পারো, তার ব্যবস্থা আমি করে রেখেছিলাম তোমাদের হাতে কিডন্যাপড হবার কিছুক্ষণ আগেই!”
কথাটা বলেই হাসতে শুরু করলেন ত্রিভূবন। তার মলিন হয়ে আসা দূর্বল চেহারায় সেই হাসিটা ভয়ঙ্কর দেখাতে লাগলো! হাসতে হাসতেই আবারও খিঁচুনি উঠলো তার। এক পর্যায়ে নিথর হয়ে এলো তার দেহ।
“ডক্টর ত্রিভূবন! ডক্টর ত্রিভূবন!” ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের কলার ধরে ঝাকাতে লাগলো বদি। কিন্তু তার মুখ দিয়ে আর টু শব্দটিও বের হল না। বদি খেয়াল করল, ডক্টর ত্রিভূবনের ঠোঁট নীল হয়ে এসেছে। তার গলার কাছে লাল র‍্যাশও চোখে পড়ল বদির। তার বুঝতে বাকি রইলো না, তাদের হাতে অপহৃত হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই ভয়ানক কোনো বিষ খেয়ে নিয়েছিলেন ডক্টর ত্রিভূবন রায়!
বিস্ফারিত চোখে ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো বদি।

১৪ মার্চ, ২০১৯
রাত ১২:৩০ টা
মাজহার হতে পারত একজন শিল্পী, একজন সাহিত্যিক, একজন দার্শনিক, কিংবা একজন বিজ্ঞানী। কিন্তু সে সেসবের কিছুই হয় নি। আজ সে যা হয়েছে তা হওয়ার কথা সে আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও কল্পনা করে নি। তবে পাঁচ বছর আগে সে স্বপ্ন দেখেছিলো, সে টাকার পাহাড় গড়বে! আর সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতেই আজ সে একজন তৃতীয় শ্রেণীর প্রতারক। প্রতারণা করে অন্যের টাকা আত্মসাৎ করার ক্ষেত্রে বিগত চার-পাঁচ বছরে সে একাই ঢাকা শহরের অনেক বড় বড় প্রতারক চক্রকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে এই মুহুর্তের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। এই মুহুর্তে সে যত বড় প্রতারক, তার চাইতেও বড় অসহায়! পুলিশ তাকে খোঁজাখুঁজি করছে, আর সে পুলিশের ভয়ে এখান থেকে ওখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশকে তার খবর জানিয়েছে তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহযোগী মিজান।
মাজহার এখন পশ্চিম রামপুরার উলন রোডের একটা বাড়িতে লুকিয়ে আছে। বাড়িটা পরিত্যাক্ত। একে তো রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার মাঝখানে আবার লোডশেডিং! তাই মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে বাড়ির ভেতরের সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে সে। উদ্দেশ্য, দামী কিছু পেলেই তা চোরাই মার্কেটে বিক্রি করে ঢাকা থেকে দূরে কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দেয়ার মত কিছু টাকার ব্যবস্থা করা। তার বন্ধু মিজান পুলিশকে শুধু তার খবরই দেয় নি, সে তার সব টাকা পয়সা নিয়েও পালিয়েছে। মাজহারের পকেটে এখন একটা টাকাও নেই।
বাড়িটা বিরাট বড়। কিন্তু বাড়ির ভেতরে কোথাও দামী তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। বসার ঘরে কিছুই না পেয়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকলো মাজহার। এটা বাড়ির মালিকের ব্যক্তিগত লাইব্রেরী, বুঝতে পারল সে। বিশাল এই ঘরটির চার দেয়াল জুড়ে অন্তত হাজার দশেকের ওপরে বই আছে! কয়েকটা বইয়ের নাম পড়তে গিয়ে রীতিমত দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হল মাজহারের! পড়ার ঘরে কিছু পাওয়া যাবে না, এই ভেবে বেরিয়ে যাচ্ছিলো মাজহার, এমন সময় তার চোখ আটকে গেল টেবিলের ওপরে রাখা একটা জিনিসের ওপর।
আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ!
জিনিসটা দেখতে ওরকমই। দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরনো আমলের এ্যান্টিক। মাজহার মনে মনে ভাবলো, এ্যান্টিক পিস হলে এটা থেকে কয়েক হাজার টাকা তো পাবই! কিন্তু কাছে গিয়ে জিনিসটা হাতে নিতেই দমে গেলো মাজহার। জিনিসটার ওজনই বলে দেয় যে এটা সস্তা জিনিস। কয়েক মাসের ধূলো ময়লা জমে অন্ধকারের মধ্যে পুরনো আমলের এ্যান্টিক মনে হচ্ছিলো।
“যাক! লোহা লক্কড়ের দোকানে বিক্রি করে পঞ্চাশ টাকা পেলেও লাভ!” প্রদীপটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে আপনমনে বলল মাজহার, “অন্তত একবেলার খাবার তো খাওয়া যাবে!”
প্রদীপটার ওপরে জমে থাকা ধূলো জোরে জোরে ঘষে পরিষ্কার করতে লাগলো সে। প্রদীপটা ঘষতে ঘষতে তার মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার কথা। ছেলেবেলায় আরব্য রজনীর পোকা ছিল সে। আরব্য রজনীতেই সে পড়েছিলো আলাদীনের গল্প, আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প। সেখানেও এভাবে ঘষে ঘষে প্রদীপ পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রথমবার প্রদীপের দৈত্যকে বের করে এনেছিলো আলাদীনের মা। ছেলেবেলার কথা মনে করে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলল মাজহার।
হঠাৎ প্রদীপের ভেতরে ক্লিক করে একটা শব্দ হল। চমকে উঠে হাত থেকে প্রদীপটা ফেলে দিলো মাজহার। সে বিস্ফারিত চোখে দেখলো, প্রদীপটির ভেতর থেকে উজ্জ্বল নীলাভ আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে! ধীরে ধীরে সেখানে ভেসে উঠলো একটি অতিকায় মূর্তি! মূর্তিটিকে দেখে আর দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না মাজহার, জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
“প্রভু, আমি আপনার আজ্ঞাবহ দাস প্রদীপের দৈত্য।” মূর্তিটি যান্ত্রিক গলায় বলতে আরম্ভ করল, “ডক্টর ত্রিভূবন রায় আমার কাছে তার নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টরের ডিজাইনটি দিয়েছেন আপনার কাছে পৌছে দেয়ার জন্য।”
অতিকায় দেখতে প্রদীপের দৈত্যটির পাশে ভেসে উঠলো নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টরের বিভিন্ন অংশের ডিজাইন। প্রদীপের দৈত্য বলতে লাগলো, “প্রভু, এই হলোগ্রাফিক ভিডিওটির দৈর্ঘ্য দশ মিনিট, যার এক মিনিট ইতোমধ্যেই পাড় হয়ে গেছে। অবশিষ্ট নয় মিনিটের মধ্যেই আপনাকে এই ডিজাইনটি তুলে ফেলতে হবে। এই ভিডিওটি শেষ হওয়ার ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই প্রদীপটি বিস্ফোরিত হবে। আপনি ডিজাইনটি নিয়ে সরকারের কাছে হস্তান্তর করবার আগে যাতে এটা অন্য কারো হাতে না পড়ে সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টরের ডিজাইনটি নিয়ে ত্রিশ মিনিট পাড় হবার পূর্বেই প্রদীপটি রেখে দ্রুত প্রস্থান করুন। বিদায় প্রভু।”
কথাগুলো বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল প্রদীপের দৈত্যের হলোগ্রাফিক ছবিটি।

১৩ মার্চ, ২০১৯
রাত ১১:৪০ টা

কার একসিডেন্টে গুরুতর আহত হয়ে প্রায় নয় মাস কোমায় থাকার পর এক সপ্তাহ হল ডক্টর রাহাত কামালের জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার পর পরই তিনি একটা দুঃসংবাদ পেয়েছেন- তার বন্ধু এবং সহকর্মী ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে! তার একসিডেন্ট হওয়ার মাত্র দুই তিন দিন পরই একটা কালো রঙের মাইক্রোবাস ত্রিভূবন রায়ের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় ত্রিভূবন রায়ের মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়। এই দুঃসংবাদের ধাক্কাটা সামলে উঠতে বেশ অনেকটা সময় লেগেছে ডক্টর রাহাত কামালের।
আজ বিকেলেই তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে ঘণ্টাখানেক হল তিনি বসেছেন ই-মেইল চেক করতে। নয় মাসে প্রচুর ই-মেইল এসেছে তার কাছে, যেগুলোর বেশিরভাগই এখন অর্থহীন। চেক করতে করতে হঠাৎ করেই তার চোখ আটকে গেলো আজ থেকে নয় মাস আগে পাঠানো একটা ই-মেইলের ওপর। ই-মেইলটা তাকে পাঠিয়েছেন ডক্টর ত্রিভূবন, তার একসিডেন্ট হওয়ার আগের দিন!
ই-মেইলটা ওপেন করতেই দেখতে পেলেন, ডক্টর ত্রিভূবন তাকে একটা ভিডিও পাঠিয়েছেন। ভিডিও টা দ্রুত ডাউনলোড করে প্লে করলেন তিনি। উনত্রিশ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে দেখা গেলো ডক্টর ত্রিভূবন নিজের স্টাডি রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন একহাতে আলাদীনের প্রদীপের মত দেখতে একটা প্রদীপ হাতে নিয়ে। তার অন্য হাতে ক্যামেরাটা ধরে রেখেছেন তিনি, যেটা দিয়ে এই ভিডিওটি করেছেন।
“রাহাত! আমার এই ভিডিওটি যখন তুমি দেখবে তখন হয়ত আমি বেঁচে থাকব না!” রুদ্ধশ্বাসে বলতে লাগলেন ডক্টর ত্রিভূবন রায়, “আমি তোমাকে সবকিছু বলেও যেতে পারছি না, তার কারণ আমার আমার হাতে সময় খুবই কম। শোনো, হাস্যকর মনে হলেও এটাই সত্যি, আমার ত্রিশ বছরের রিসার্চের ফসল এই প্রদীপের দৈত্যের কাছেই আছে! দৈত্য সেটা তোমাকে দেয়ার পর যত তাড়াতাড়ি পারো সেটা সরকারের হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা করবে। দৈত্যকে কীভাবে ডাকবে সেটা অবশ্যই তুমি জানো। তবে হ্যা, দৈত্যকে ডাকার আগে প্রদীপটা অবশ্যই লোকালয় থেকে দূরে কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে যাবে।”
স্ক্রীণ অন্ধকার হয়ে গেলো, যার অর্থ ভিডিও শেষ। কিন্তু প্রদীপের দৈত্য? এ কী করে সম্ভব?! বিস্ময়ের সীমা রইলো না ডক্টর রাহাতের। আবার ডক্টর ত্রিভূবনের কথা তো একেবারে ফেলেও দেয়া যায় না! কারণ তার সঙ্গে ডক্টর রাহাতের দীর্ঘ ছত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব, তারা একসঙ্গে বিভিন্ন বড় বড় প্রজেক্টে কাজ করেছেন। ডক্টর রাহাত তার এত বছরের পুরনো বন্ধুর সম্পর্কে এটা অন্তত জানেন যে তিনি কখনোই বাজে কথা বলার মত মানুষ ছিলেন না। তার আশ্চর্য প্রদীপ আর সেই প্রদীপের দৈত্যের পেছনেও নিশ্চয়ই অনেক বড় কিছু একটা লুকোনো আছে! আর তাছাড়া একজন মৃত্যু পথযাত্রী তো আর এমনি এমনি এরকম হাস্যকর রসিকতা করবেন না, যেখানে তিনি জানেন যে আর কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি মারা যাবেন!
ডক্টর রাহাত কামাল তার কম্পিউটারের মনিটরের পাশ থেকে তার সেলফোনটা তুলে নিলেন। তারপর কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে একটা নাম্বার বের করে সেই নাম্বারে কল দিয়ে ফোনটা কানে লাগালেন।
“হ্যালো বস।” কিছুক্ষণ রিং হবার পর ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ।
“হ্যা বদি।” ডক্টর রাহাত গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তোমার কি মনে আছে ডক্টর ত্রিভূবন মারা যাবার আগে কী কী বলেছিলেন?”
বদি উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আবোল-তাবোল সব কথা বস! যতদূর মনে পড়ে কোন এক দৈত্যের কথা বলছিলেন, তার কাছে নাকি ডিজাইনটা আছে!”
“হুম।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন ডক্টর রাহাত। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “শোনো, তুমি এখনই ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের বাড়িতে যাবে। পুরো বাড়ি খুঁজে দেখবে আলাদীনের প্রদীপের মত দেখতে কোনো প্রদীপ পাওয়া যায় কিনা! তারপর প্রদীপটা পাওয়া মাত্রই সেটা নিয়ে আমার বাসায় চলে আসবে।”
বদি ইতস্তত করে বলতে চাইলো, “কিন্তু বস...”
“কোনো কিন্তু না!” ডক্টর রাহাত ধমকে উঠলেন, “আমি আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে এখানে দেখতে চাই!”
বলেই লাইন কেটে দিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন টেবিলের ওপরে। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলেন তিনি। ডিজাইনটা এত সহজেই তার হাতে চলে আসবে, এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। কী করেন নি তিনি এই ডিজাইনটা হাতানোর জন্য? ছত্রিশ বছরের বন্ধুত্বকে পর্যন্ত বলি দিয়ে দিয়েছেন! আর দেবেন না-ই বা কেন? যেই পার্টির কাছে তিনি এই ডিজাইনটা বিক্রি করতে যাচ্ছেন, তারা তাকে আগাম একশো কোটি ডলার দিয়েছে এই ডিজাইনটার জন্য!
ফোনটা আবার হাতে হাতে তুলে নিলেন রাহাত কামাল। তারপর একটা নাম্বারে কল দিয়ে ফোনটা কানে ঠেকালেন। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
“হ্যালো ড. কামাল। বলুন কী খবর?” ওপাশের লোকটি ইংরেজীতে প্রশ্ন করল।
“মিস্টার ডেভিড!” ড. রাহাত কামাল উত্তেজিত স্বরে ইংরেজিতেই বললেন, “ড. ত্রিভূবন রায়ের নিউক্লিয়ার ডিভাইসের ডিজাইনটা অবশেষে পাওয়া গেছে!”
“চমৎকার! যাক, নয় মাস পরে হলেও পাওয়া তো গেলো! আমরা তো আরো ভাবছিলাম...”
“কী ভাবছিলেন?”
“ভাবছিলাম আগাম একশো কোটি টাকা নিয়ে আপনি আবার চম্পট দিলেন কিনা!”
“কী যা তা বলছেন?! আপনারা জানতেন না এই নয় মাস আমি কী অবস্থায় ছিলাম?”
“ওসব আমাদের দেখবার বিষয় না ড. কামাল। আপনি এখন আমাকে বলুন, ডিজাইনটা আমরা কখন পাচ্ছি?”
“আগে তো আমি হাতে পাই! ওটা আমি হাতে পেয়ে যাবো আগামী এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই।”
“ঠিক আছে। আমার লোক তাহলে বাকি টাকাসহ দেড়ঘণ্টা পর আপনার বাসায় চলে যাবে।”
“ঠিক আছে মিস্টার ডেভিড।”
“কিন্তু একটা কথা।”
“কী কথা?”
“আমার লোক যদি আপনার কাছ থেকে ডিজাইনটা না পায়, তবে পুলিশ আপনার মৃতদেহ পাবে। মনে থাকবে তো বিষয়টা?”
কয়েক মুহুর্তের জন্যে চুপ হয়ে গেলেন ড. রাহাত কামাল। তারপর শুকনো গলায় বললেন, “মনে থাকবে মিস্টার ডেভিড।”
“ভেরি গুড। রাখছি তাহলে।”
লাইন কেটে গেলো। রাহাত কামাল ফোনটা আবার রেখে দিলেন টেবিলের ওপরে। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন।
“আমি দুঃখিত ত্রিভূবন।” মুচকি হেসে আপনমনে বললেন ডক্টর রাহাত, “তোমার কাছে তোমার দেশ আগে, আর আমার কাছে আমার পকেট!”

তিন দিন পর
- ডক্টর ত্রিভূবন রায়ের বাড়িতে পাওয়া লাশ দু’টোকে কি শনাক্ত করা গেছে?
- জ্বী স্যার। আগুনে পুড়ে আর বিল্ডিং-এর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থেতলে যাওয়ার পরেও ওদের পরিচয় বের করতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। ওদের একজন হচ্ছে ভাড়াটে খুনি বদি, আর অন্যজন ফ্রড কেসের আসামী মাজহার।
- হুম। ভাড়াটে খুনি বদি, ফ্রড মাজহার আর বিজ্ঞানী ডক্টর ত্রিভূবন রায়- এই তিনজনের মধ্যে কী কানেকশান থাকতে পারে?
- স্যার, ব্লাস্টের সোর্সটাও পাওয়া গেছে। ব্লাস্টটা হয়েছে বদির পাশ থেকে পাওয়া প্রদীপটার ভেতর থেকে। বোমা ওটার ভেতরেই রাখা ছিল।
- প্রদীপের ভেতরে?
- জ্বী স্যার। প্রদীপের দু’পাশের মেটাল প্লেটের নিচে একটা হিট সেন্সর মডিউল লাগানো ছিল, আর সেটা বোমার সঙ্গে যুক্ত ছিল সুইচ হিসেবে। প্রদীপে ঘর্ষণের কারণে যে তাপ উৎপন্ন হয়েছিলো, সেই তাপ হিট সেন্সরের রেঞ্জের মধ্যে পৌঁছানো মাত্রই অন হয়ে গিয়েছিলো বোমার টাইমার!
- ইন্টারেস্টিং!
- আরো একটা ব্যাপার স্যার। প্রদীপের ভেতরে বোমার সার্কিটটা ছাড়াও আলাদা একটা ইলেকট্রনিক ডিভাইস পাওয়া গেছে, সেটার সাথে আবার একটা মিনি হলোগ্রাফিক ভিডিও প্রজেক্টরও ছিল। আর সেই ডিভাইসটাও ঐ সেন্সরের সাথে কানেক্টেড ছিল।
- সেগুলোও সব পুড়ে গেছে নিশ্চয়ই?
- বলতে গেলে পুরো কেসটাই পোড়া স্যার! সেই সঙ্গে কেসের এভিডেন্সগুলোও সব পোড়া!
- বড্ড গোলমেলে লাগছে পুরো কেসটা। এদিকে আবার ওপর থেকে অর্ডার এসেছে, আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে এই কেসের সমাধান করে সব আসামীদের এরেস্ট করতে হবে!
- আপনি একদম চিন্তা করবেন না স্যার। আমি দু’দিনের ভেতর এই কেসের প্রোগ্রেস রিপোর্ট আপনার টেবিলে এনে রাখব।
- ঠিক আছে। ওভার অ্যান্ড আউট।
-ওহ হ্যা স্যার, আরেকটা কথা!
-কী কথা?
-ড. রাহাত কামালের ফরেনসিক রিপোর্টটাও চলে এসেছে। তার মৃত্যুর সময়টা শুনলে রীতিমত চমকে যাবেন স্যার।
-তাই নাকি? সময়টা কখন?
-সময়টা হচ্ছে আজ থেকে তিনদিন আগে, রাত সোয়া একটা থেকে দেড়টার মধ্যে।
-বলো কী?! তারমানে ড. ত্রিভূবন রায়ের বাড়িতে ব্লাস্ট হওয়ার প্রায় একঘণ্টা পরেই ড. রাহাত কামাল খুন হয়েছেন?
-জ্বী স্যার। আমার তো মনে হচ্ছে এটা নেহায়েত কোনো কাকতালীয় ব্যাপার না, বরং এই দু’টো কেস ইন্টাররিলেটেড।
-ইন্টাররিলেটেড হোক বা না হোক, আমি দু’টো কেসেরই প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেখতে চাই অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল!
-ওকে স্যার।
-নাউ ওভার অ্যান্ড আউট।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ