সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে: পর্ব ৪



নন্দিনী সেন


এতদিন যাত্রীরা আমাকে নিজের লোক মনে করে একটু মন খুলে মিশছিল, কিন্তু এই ঘটনার পর আর আমার নিজেকে সরকারের লোক বলে পরিচয় দেওয়াতে সকলের দৃষ্টির মধ্যে কেমন একটা সমীহ ভাব দেখা দিল। এতে হয়ত তাদের কাছ থেকে আমি একটু দূরে চলে এলাম কিন্তু ওই মুহূর্তে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলনা। যাই হোক, যা হওয়ার হয়ে গেছে আর বোধহয় একদিক থেকে ভালোই হল এরপর এই ধরনের পরিস্থিতি হয়তোবা আর দ্বিতীয়বার ঘটবে না। আমি একটু চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করে ভাবলাম ছেলেটি বা বৈরাগী কি আমার কাছে সত্যি কথা বলবে? কি জানি! হঠাৎ গায়ে একটা মৃদূ চাপ অনুভব করলাম। চোখ খুলতেই দেখি মাসিমা একটা ছোট্ট থার্মোকলের বাটিতে অল্প মুড়ি ও দুটো বাতাসা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন আর কিছুটা ভালবাসা মিশ্রিত আদেশের সুরে বললেন, খেয়ে নাও৷ বলে তিনি অন্য দিকে চলে গেলেন আর আমিও বিনা বাক্যে একগাল মুড়ি মুখে পুড়লাম। মনে হল মায়েরা বোধহয় এমনই হন। ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে লাগল। সকলেই এখন দুপুরের খাবার তৈরীতে ব্যাস্ত। আমার তো আর সে সবের বালাই নেই, আর এক জায়গায় একভাবে বসে থাকতেও ভাল লাগছেনা৷ সিট ছেড়ে উঠে একটু এগিয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম বৈরাগী ও তার স্ত্রী কেমন অসহায় দৃষ্টিতে জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর যে ছেলেটির ঘড়ি চুরি গেছে সে মুখ গোজঁ করে বসে আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। গোটা কামরা ভাতসেদ্ধ ও ডালসেদ্ধর গন্ধে ম ম করছে। এইভাবে ট্রেনে রান্না করা যথেষ্ট বিপদের, কিন্তু এরা নির্বিকার। আমি একটু খোলা হাওয়ার জন্য দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরের দিকে তাকিয়ে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ‘বাবু’ ডাকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি একটি ষোল সতের বছরের ছেলে ভয়েভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটিকে তো ঐ বৈরাগীর সামনে কাল বসে থাকতে দেখেছি। এর আবার কি হল? প্রশ্ন করতেই ছেলেটি আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল। কি আছে তার হাতে? দেখি একটা ঘড়ি। ছেলেটি কিছু না বলে আমার পা ধরে বলল, আমাকে বাচাঁন, আমি অন্যায় করেছি। আমিই ঘড়িটা চুরি করেছি৷ আমি ওকে তুলে বললাম, কেন চুরি করলে? ছেলেটি বলল, ওরকম একটা ঘড়ির খুব শখ ছিল তাই লোভ সামলাতে পারিনি। আমি অন্যায় করেছি, আমাকে দয়া করে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেবেন না। আমি কিছু না বলে ছেলেটির মাথায় হাত রাখলাম আর মনে মনে বললাম, আমি কাউকে নামিয়ে দেওয়ার কে? আমি নিজেই তো অযাচিত ভাবে এই ট্রেনে উঠে পড়েছি। ঘড়িটা হাতে নিয়ে আবার কামরার ভিতরে ঢুকে যার ঘড়ি চুরি গেছিল তার হাতে দিয়ে বললাম বিনা কারণে কাউকে চোর বদনাম দিওনা। ঘড়িটা হাতে নিয়ে ছেলেটি অবাক ও লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে নিল। আর বৈরাগী চোখভরা জল নিয়ে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে হাতজোড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল কোনো কোনো মিথ্যা একশটা সত্যির থেকেও বড় হয়৷

 

গৌতম সরকার

সকালের ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার জন্যেই হোক বা অন্য কারণে দুপুরের পর কামরাতে চিৎকার-চেঁচামেচি একটু কম মনে হল। এই সুযোগে একটু ঘুমিয়ে নিলাম, গত রাতে একদমই ঘুম হয়নি।  বেশ কয়েকঘন্টা নিঃশব্দে ঘুমিয়ে যখন উঠলাম তখন জানলার ফাঁক দিয়ে পশ্চিম আকাশ লালে লাল, সূর্যদেব ইতিমধ্যেই পাটে বসেছেন। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগলো। উঠে বসতেই মাসিমা একটা চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন। মুখে বললেন, "দেখো, চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, জুড়িয়ে গেল কিনা!" আমি নীরব কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কি জানাতে পারি। ভদ্রমহিলা শুধু নিজের স্বামীর নয়, আমার ভারও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। চা খেয়ে টয়লেটের দিকে হাঁটা দিলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম সকালের সেই ছেলেটি, যার ঘড়ি হারিয়েছিল বিষন্ন দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছে, আর সেই সাধকবাবা নিজের স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছেন। দুজনের দিকে তাকিয়ে ঠাকুরকে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানালাম। সকালে ছেলেটি উপযাচক হয়ে ঘড়িটি ফেরত না দিলে আবার এখন সেই অপ্রিয় সওয়াল-জবাব শুরু করতে হত। আরে বাবা, সকালবেলায় কি একটা ঘটে গেল, ফলে ওভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। আসলে আমি কোনোদিনই খুব জোর গলায় কথা বলতে পারিনা; যেকোনো সমস্যা থেকে দশহাত দূরে থাকাই আমার স্বভাব। সকালবেলায় একটা ঘোরের মধ্যে ওসব কথা বলে ফেলেছি। এখন আবার ওসব নিয়ে চাপানউতোরের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বুকটা খুব হালকা লাগছে। টয়লেট সেরে বেরিয়ে দেখি বাবাজি উঠে বসেছে, আমাকে দেখে হাত তুলে প্রণাম জানালো। আমি প্রতি নমস্কার জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম৷ ছেলেটি এখনও জানলার বাইরে তাকিয়ে। আমার পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে তাকাতে দেখি চোখ দুটো লাল; অনেকক্ষণ দুচোখ হাত দিয়ে কচলালে যেমন হয় তেমনি। আমি একটু থমকে দাঁড়ালাম, ছেলেটি কি করবে বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়ালো। আমি তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে বসতে বললাম। আমি উদ্বেগের স্বরে বললাম, "তোমার কি শরীর খারাপ?" ছেলেটি ঘাড় নেড়ে না বললো। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, "তবে কি হয়েছে, তোমার চোখ লাল হলো কি করে?" এখন মনে হল ছেলেটি কাঁদছিলো। ছেলেটি ততক্ষণে বসে পড়েছে, আমার প্রশ্নের উত্তরে আরও ঘুরে গিয়ে জানলার কাঁচে মাথা রেখে মুখ নিচু করলো। আমি পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। আমার হাতের স্পর্শে কি ছিল জানিনা, কাঁধে একটু সহানুমর্মিতার চাপ পড়তেই ছেলেটি থরথর করে কেঁদে উঠলো, কিন্তু কোনো আওয়াজ উঠলো না। শুধু বুঝতে পারলাম কান্নায় ওর পিঠটা বেঁকে যাচ্ছে, আর জানলার কাঁচ বেয়ে চোখের জলের ধারা নিচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও সেটা আমি ছাড়া আর কারোর চোখে পড়ছেনা। মনে মনে ভাবলাম আরেকটা মর্মন্তুদ জীবন সংগ্রামের কাহিনী এই হু হু করে ছুটে যাওয়া ট্রেনটির দেওয়াল, জানলা, দরজায় মাথা কুটে মরছে। এই সময় ছেলেটির পাশে থাকা দরকার।

    ছোট্ট একটি গ্রাম, নাম নবজীবনপুর। কলকাতা শহর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে। মূলতঃ কৃষিনির্ভর গ্রাম, যদিও জমি উর্বরা নয়। বছরে দুটো ফসল ফলাতে গায়ের রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে। এইরকম পরিবারের ছেলেদের লেখাপড়া হয় ওই প্রাথমিক বা হাই স্কুলের কয়েক ক্লাস পর্যন্ত। তারপর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বাবার সাথে লাঙল কাঁধে জমিতে নেমে পড়তে হয়। এরকম গ্রামের এক কৃষক কানাইয়ের চোখে অন্যরকম স্বপ্ন ছিল। চিরকাল জমিতে খেটে খাওয়া বংশে এই স্বপ্ন কোন ছিদ্রপথে এসে দংশন করেছিল সেটা অবোধ্যই ছিল। ছেলে হওয়ার পর থেকেই নিজের স্বপ্নের কথা স্ত্রীকে বলতো, "এ ছেলেকে আমি জমিতে খাটতে দুবুনি, একে আমি ল্যাখাপড়া শেখাবো।" বউ শুনতো, বাবা,শুনতো, মা শুনতো, সবাই এটা কথার কথা ভেবে পাত্তা দিতোনা। পরে যত সময় গেল কানাইয়ের জেদ তত বেড়ে গেলো, বাড়ির লোক প্রমাদ গণলো। চাষির ছেলে চাষি হবে, এটাই তো সরল উপপাদ্য, এ আমার কি অলুক্ষনে ইচ্ছে ! সারাক্ষণ তার মাথার মধ্যে ছেলেকে ল্যাখ্যাপড়া শেখাবো, শহরের বড় স্কুলে ভর্তি করবো, ছেলে পাশ করে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হবে এইসব ছাইপাঁশ চিন্তা৷ কারোর ওজর আপত্তি টিকলোনা, পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও বছর বছর পাশ করে যেত আকাশ। কিন্তু তারও যে গ্রাম ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে শহরের স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল তা নয়। কিন্তু বাবাকে সে আপত্তির কথা বলতে পারতোনা। প্রতিদিন রাত্রে পাশে শুইয়ে বাবা যে ভবিষ্যতের দিনগুলো নিয়ে নকশিকাঁথার জাল বুনতো, সেই স্বপ্নকে ছিঁড়ে দিতে ভয় পেত, ইতস্ততঃ বোধ করতো। ফলস্বরূপ এক সকালে বাবার হাত ধরে রেলগাড়ি চড়ে কলকাতার বেশ ভালো স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলো। কলকাতায় কোনো আত্মীয় থাকার কথা নয়, নেইও। তাই নিজের ক্ষমতার অনেকটা বাইরে গিয়ে ছেলেকে হোস্টেলে রেখে বাবা স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরলো।

      কলকাতায় কদিন থাকার পরই আকাশ টের পেল -এ দুনিয়া তার জন্যে নয়। এখানকার ছেলেমেয়েদের আদব-কায়দা, সহবত, শিক্ষকদের আচার-আচরণ, পড়ানোর কায়দা, স্কুলের আর হোস্টেলের নিয়মকানুন কোনোকিছুর সাথেই সে খাপ খাওয়াতে পারছেনা। পড়াশোনায় প্রথম থেকেই যথেষ্ট পিছিয়ে পড়েছে, নিজের কথাবার্তা, আদব-কায়দায় স্কুলের বন্ধুদের কাছে হাসির খোরাক হয়ে উঠছে, কিছু কিছু মাস্টারমশাইও তার দিকে বাঁকা চোখে তাকান ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সে বাবাকে বলেনা। হোস্টেলে তবু কিছুটা শান্তিতে থাকে। তার ঘরে আরেকটি ছেলে আছে সেও বাইরে থেকে এসেছে। দুজনের সমস্যা যেহেতু একইরকম তাই দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। বাবা প্রতিমাসে এসে হোস্টেলের সুপারকে টাকা দিয়ে যায়, ছেলের হাতেও হাতখরচ বাবদ কিছু দেয়। যাওয়ার সময় ছেলের মাথায় হাত রেখে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলে। আকাশ বোঝে বাবা নিজেকে নিঃস্ব করে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে, তারজন্য বোধহয় দুবেলা দুমুঠো পেটভরে খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। বাবাকে লজ্জায় পড়াশোনায় পিছিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারেনা, কলকাতায় যে সব ব্যাপারেই তার অসুবিধা হচ্ছে বলতে পারেনা। ইতিমধ্যে হোস্টেলের অন্যান্য বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বিড়ি-সিগারেটের নেশা ধরে ফেলেছে।  ক্রমে ক্রমে পড়াশোনা বাদে অন্যদিকে মন গেলো। নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেললো। এখন শহুরে জীবনের মোহ তাকে পেয়ে বসেছে, নেশার জিনিস কেনার জন্যে মিথ্যে বলে বাবার কাছ থেকে বেশি বেশি পয়সা আদায়ের ফন্দি-ফিকির শিখলো; নেশার সঙ্গীরাও এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে লাগলো। ফলস্বরূপ পরপর দুবছর একই ক্লাসে ফেল করলো। প্রথমবার চূড়ান্ত হতাশ হলেও বাবা ছেলেকে নিজের অবস্থা বিশদভাবে বলে পড়াশোনায় আরোও বেশি করে মন দিতে বললো। ইতিমধ্যে হোস্টেল সুপার আর অন্যান্য মাস্টারমশাইয়েদের কাছ থেকে ছেলের বখে যাওয়ার খবর পেলো। তবুও নিজের স্বপ্ন চরিতার্থ করতে ছেলেকে অনেক বোঝালো। কিন্তু দ্বিতীয় বছরেও একই ফল হতে বাবা ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু ছেলে তখন নাগরিক নেশায় মশগুল, বাবার সাথে ঝগড়া, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করে শহরেই রয়ে গেল। স্কুল যাওয়া বন্ধ করলো, হোস্টেলে জায়গা হলনা; বাধ্য হয়ে বাবাকে না জানিয়ে একটা গ্যারেজে চাকরি নিল। বাবা অনেকদিনই মাসে মাসে শহরে আসা বন্ধ করেছে, এখন মাস গেলে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠায়। সেই পয়সায় আর নিজের উপার্জনের পয়সায় শহরের কিছু বাজে ছেলের সাথে জুটে আরোও নতুন নতুন নেশার পিছনে ছুটে বেড়াতে লাগলো।

    দিন কাটতে লাগলো। টাকাপয়সা ছাড়া বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক থাকলো না। লোকমুখে শুনলো, তাকে লেখাপড়া শেখানোর খরচ যোগাতে বাবা তার সাধের জমিগুলো সব বিক্রি করে দিয়েছে, আর ক-টুকরোই বা জমি ছিল! এখন পরের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে, তাও রোজ কাজ জোটে না। নেশা তাকে এমনভাবে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলল, এসব খবর তাকে সেভাবে স্পর্শ করলোনা। সে নিজের মতো বোহেমিয়ান জীবন কাটাতে লাগলো। তারপর অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো এই মহামারি শুরু হলো। প্রথমে ব্যাপারটাকে কেউ পাত্তা না দিলেও ক্রমশঃ তার চেহারা ব্যাপক আকার ধারণ করলো। সে যে বস্তিতে থাকতো সেখানেও এই শয়তান হানা দিলো। কয়েকদিনের মধ্যে কয়েকশো মানুষ আক্রান্ত হলো, তার মধ্যে মারাও গেল অনেকে। তখন সরকারের তরফ থেকে ধরে বেঁধে বাকি মানুষগুলোকে তুলে দেওয়া হলো এই অনিশ্চিতপুরের রেলগাড়িতে। এই পর্যন্ত বলে দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো ২০-২১ বছর বয়সী ছেলেটি। কতটুকুই আর বয়স! আমার সন্তানের বয়সী। এইটুকু বয়সেই জীবনের কত জঞ্জাল ঘেঁটে দুটো হাত নোংরা করে ফেলেছে। আমি আরেকটু কাছে এগিয়ে ওকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলাম। অনেকদিন পর বাবার শরীরের ছোঁয়া পেয়ে এবার ছেলেটি উচ্চৈঃস্বরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো। কামরার সবাই চমকে উঠলো। তারা এতক্ষণ এদিকে অতটা লক্ষ্য করেনি, ভাবছিলো সকালের ব্যাপারটা নিয়েই বোধহয় কথা বলছি। ছেলেটি ঘুরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা গলায় ককিয়ে উঠলো, " আমাকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন, ওরা জানেনা আমি নিরুদ্দেশের ট্রেনে উঠে পড়েছি। আমি ছাড়া ওদের কেউ নেই। ওরা কিভাবে বেঁচে আছে আমি জানিনা। অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর ওদের কষ্ট দিতে চাইনা। আমি যেতে চাইনা এই অনিশ্চিতপুরে। আপনার পায়ে পড়ি, আপনি সরকারের লোক, আপনি পরের স্টেশনে গাড়ি থামিয়ে আমাকে নামিয়ে দিন।" এই বলে আমার হাতে মাথা ঘষতে লাগলো। ওর চোখের জলে আমার হাত ভিজতে লাগলো। আর এই প্রথমবার মিথ্যা কথা বলার জন্যে আমি চরম লজ্জা পেতে লাগলাম।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ