সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে: পর্ব ৩

                                           

গৌতম সরকার


সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোরবেলায় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল কারোর মৃদু ধাক্কায়। বহু কষ্টে চোখ মেলে দেখি সামনের সিটের মাসিমা উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে চেয়ে, চোখে একটা অপরাধবোধ আবার একই সঙ্গে আকুতি খেলে বেড়াচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে উনি ওনার স্বামীর দিকে ইশারা করলেন। আমি চমকে উঠলাম, মানুষটা সিটের সাথে মিশে গেছেন আর প্রচন্ড হাঁফানির টানে গোটা শরীর ছিলে ভাঙা ধনুকের মত বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। প্রাথমিক ভাবে খুব অসহায় বোধ করলাম, কিছুক্ষণ বুঝে উঠতে পারলাম না কি করবো! সাময়িক দ্বিধা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম এই মুহূর্তে দেওয়ার মতো কোনো ওষুধ আছে কিনা! উনি বললেন, সকালে উঠেই একটা ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ওনার কষ্ট বেড়েই চলেছে। অনেকক্ষন দেখার পর উপায়ান্তর না পেয়ে উনি আমার ঘুম ভাঙিয়েছেন। ইতিমধ্যে আশেপাশের কয়েকজন এসে দাঁড়িয়েছে, তারাও বিভিন্নভাবে ভদ্রমহিলাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। আমার ছোটবেলায় দেখা ঠাকুমার এক ঘরোয়া নিদানের কথা মনে পড়ে গেল। আমি ব্যাগ খুলে নারকেল তেলের শিশি বের করলাম, একটা বাটিতে কিছুটা জলে কয়েক ফোঁটা তেল মিশিয়ে ভদ্রলোকের পাশে বসলাম। জামার ওপরের কয়েকটি বোতাম খুলে খুব ভালো করে বুকে তেলজল মালিশ করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে ভদ্রলোকের কষ্ট একটু একটু কমতে লাগলো। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনেকটা স্বাভাবিক হলো, একটু পরে উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি এরপর বুকের বোতামগুলো লাগিয়ে বুক পর্যন্ত পাতলা চাদরটা টেনে দিলাম। আমি তো জানি এতে আমার কোনো কেরামতিই নেই কিন্তু ওরা কেউ শুনলোনা। মাসিমা গভীর আবেশে আমার হাত দুটি ধরে ফেললেন, আশপাশের মানুষজনও কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে লাগলো। হটাৎ করে কামরার সমস্ত মানুষের ব্যবহারে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এতক্ষণ আমাকে তারা অন্য দলের মানুষ মনে করছিলেন, নিজেদের সাথে মেলাতে পারছিলেননা, কিন্তু এই ছোট্ট ঘটনায় ওরা আমাকে অনেকটা নিজেদের কাছাকাছি টেনে নিলেন। আমি এটাকে ঈশ্বরের কৃপা হিসেবেই নিলাম। আমি এদের সাথে একই তীর্থে চলেছি, সকলের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে না পারলে আমার পক্ষে পৌঁছনোর সাধ্য কোথায়! আমি তো সব জেনে, সব বুঝে এই সর্বহারা মানুষগুলোর সাথে একই নৌকার যাত্রী হয়েছি, আমাকে তাদের মনের গভীরে স্থান করে নিতেই হবে, তাদের ভালোবাসা পেতেই হবে। তা নাহলে হেরে গিয়ে ভগ্নমনোরথে মাঝপথ থেকেই ফিরে যেতে হবে। কোনো একসময় সেই চেকার এসে অনুপ্রবেশের দায়ে সবাইয়ের চোখের সামনে দিয়ে হিড়হিড় করে ট্রেন থেকে কোনো এক অজানা-অচেনা স্টেশনে নামিয়ে দেবে। তখন আমি কি করবো! আমার তো ফেরার কোনো ঠিকানা নেই! সজ্ঞানে, নিজের খেয়ালে সব আশ্রয়ে নিজ হাতে তালাচাবি দিয়ে এসেছি। সে চাবি পথে আসতে আসতে কোথায় ফেলেছি তার সন্ধান কে দেবে!



কামরার সবাই খুশি সাময়িক বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে। আমাকে বোধহয় সবাই জাদুকর বা ডাক্তার সমঝেছে। আমি কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমি তো জানি আমি কিছুই করিনি। ভদ্রলোক নিজ আয়ুর জোরে এযাত্রায় রক্ষা পেলেন। কিন্তু এভাবে কতদিন! এই মুমূর্ষু মানুষটাকে ওই অসহায় মহিলা কতদূর বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন! এই অনন্ত যাত্রার শেষ কোথায়?  আজ ট্রেনভর্তি এতগুলো মানুষকে গরু-ছাগলের মতো কামরার পর কামরা ভর্তি করে কোন অসীম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এবার এদের কি হবে? কে এদের খাওয়া-পরা, অসুখ-বিসুখের দায়িত্ব নেবে? বোকা অর্ধশিক্ষিত মানুষগুলো অনিশ্চিতপুরের স্বপ্নে বিহ্বল, এই ট্রেনযাত্রার কষ্টকে তারা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিচ্ছেনা, আগামী দিনের রঙিন স্বপ্ন তাদের বুক জুড়ে। একবার কোনোরকমে অনিশ্চিতপুর পৌঁছতে পারলেই তারা রাজার ধন হাতে পেয়ে যাবে। তাদের স্বপ্নে সুজলা-সুফলা, রোগহীন, জরাহীন, মৃত্যুহীন সেই দেশ যেখানে মানুষে মানুষে হানাহানি নেই, হিংসা নেই, মানুষ সেখানে পরস্পরের হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের জয়গান গায়। কি সুন্দর, সহজ, সরল স্বপ্ন এদের বুক জুড়ে, শিশুর স্বপ্ন এদের দুচোখে খেলে বেড়াচ্ছে, কি গভীর বিশ্বাস এদের মন ভরিয়ে দিয়েছে তুরীয় আনন্দে! কিন্তু আমার পাপ মন যে কিছুতেই এদের সাথে সহমত পোষণ করতে পারছেনা।

 


নন্দিনী সেন

 কারণ আমি জানি, আমরা এক অলীক স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলেছি। এর আদৌ কোন বাস্তবতা নেই। কিন্তু এই মানুষগুলো যারা এই স্বপ্নকে সত্যি মনে করে চলছে তাদের স্বপ্নকে ভাঙার কোনো অধিকার আমার নেই। এই অল্প জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলো যদি সেই অবাস্তবতাকে বাস্তব ভেবে একটু আনন্দ পায়, নিশ্চিন্ত থাকে থাক। আস্তে আস্তে ওরা আমাকে ওদের কাছের লোক ভাবতে শুরু করেছে। তাই আমিও ওদের সাথে ভাব জমাতে চাইলাম। মনে হল এদের প্রত্যেকের একটা নির্দিষ্ট অতীত আছে, কিভাবে বা কেন তারা এই অনিশ্চিতের পথে এগিয়ে চলেছে? আমার ঠিক কোনাকুনি একজোড়া অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে বসে আছে। সঙ্গে বছর তিনের একটি বাচ্চা। ছেলেটির সাথে চোখাচোখি হতেই একটু মুচকি হাসল আর আমিও সুযোগ বুঝে ওদের পাশে বসলাম। আমাকে দেখে অল্পবয়সি লাজুক বউটি একটু সরে ঘোমটা টেনে ঘুমন্ত বাচ্চাটিকে বুকে জড়িয়ে নিল। আমি জানতে চাইলাম তারা এপথে কেন? ছেলেটি বলল তাদের বাড়ী এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তাদের আরও দুটি সন্তান আছে। নিজের কিছু জমি ছিল, সেই জমি চাষ করে মোটামুটিভাবে পাঁচজনের পরিবার চলে যাচ্ছিল৷ কিন্তু গত দুবছর অতিবৃষ্টির জন্য সব ফসল মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে নিজের জমি বন্ধক রেখে কিছু টাকা ধার নেয় পুনরায় চাষ করবে বলে। কিন্তু সেখানে দুবেলা খাবার জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ল, নিজেরা উপোসী থাকলেও তিনটি শিশুর মুখে তো কিছু দিতে হবে। ফলস্বরূপ ধারের টাকাও গেল আর নিজের জমিও গেল মহাজনের গর্ভে। তাই বাধ্য হয়ে অন্য দুই সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে, রোজগারের উদ্দেশ্যে দুধের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে শহরে চলে আসে। একটা কাজও জুটে যায়। মোটামুটি চলছিল দিন, কিছু টাকাও জমছিল, একটাই আশা বুকে বেঁধে দিন কাটাচ্ছিল যে আবার গ্রামে ফিরে যাবে, নিজের জমি মহাজনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিজে চাষ করে সন্তানদের নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক, হঠাৎ সব ওলোটপালোট হয়ে গেল! আর ওদের এই অনিশ্চিতপুরের ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়া হল। ওদের এই কাহিনী শুনে আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম এদের এই অবস্হার জন্য কে দায়ী সরকার, সমাজ ব্যবস্থা না কি অশিক্ষা?

 

গৌতম সরকার

 এখন আর ট্রেনটাকে ট্রেন বলে মনে হচ্ছেনা, মনে হচ্ছে গোটা একটা গ্রামের চলন্ত প্রতিচ্ছবি। সকালবেলায় যে যার কাজে ব্যস্ত; পুরুষ মানুষেরা সকালের কাজ সেরে এখন বাচ্চাদের সামলাচ্ছে বা হাতে হাতে স্ত্রীদের সাহায্য করছে আর মহিলারা রান্নায় মন দিয়েছে। সব পরিবারই একটা করে কেরোসিনের স্টোভ এনেছে। একটা কম্পার্টমেন্টের মধ্যেই এতগুলো স্টোভ জ্বলছে, চলন্ত ট্রেনে খুব ভয়ানক ব্যাপার। কিন্তু ওই যে, এ যাত্রা স্বাভাবিক যাত্রা নয়। এই অনির্দেশের পথ কবে শেষ হবে কে বলতে পারে! এতগুলো মানুষ রান্না না করলে খাবে কি? খাওয়ার কথায় মনে পড়লো, বেশ খিদে পেয়েছে। ব্যাগ হাতড়ে একটা আপেল পেলাম। সেটাই জানলার পাশে বসে খেতে লাগলাম, আর দিনের ঝকঝকে আলোয় বাইরের পৃথিবীর ছুটে চলা রূপ দেখতে লাগলাম। সামনের মাসিমার গলা শুনে মনটাকে কামরার ভিতরে টেনে আনলাম। এককাপ চা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করলাম। ইচ্ছে ছিল সামনের কোনো স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ালে চা খেয়ে নেবো। কিন্তু এই ট্রেন ছুটে চলেছে তো চলেছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। মাসিমা বললেন, "চা টা খেয়ে দেখো বাবা, কেমন হলো! দামি চা তো খাওয়াবার ক্ষমতা নেই!" আমি বলে উঠি, "আরে, এসবের কি দরকার ছিল! আমি তো----"

"খাও বাবা, তোমার মেসোর জন্যে করলাম। আমিও একচুমুক খাচ্ছি।"

ভদ্রলোক দেখলাম উঠে বসেছেন, এখন অনেকটাই সুস্থ লাগছে। আস্তে আস্তে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, তার চোখের দৃষ্টি জানলার বাইরে কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে। অসীম আকাশে উনি কিসের সন্ধান করছেন সেটা বোঝার মতো ধীশক্তি আমার নেই। মাসিমার কথায় চমক ভাঙলো--

"সঙ্গে তো কিছুই নেই দেখছি, খাবার-দাবারের কি ব্যবস্থা করবে শুনি?" সত্যিই এব্যাপারটা মাথাতেই ছিলোনা। আমি এটাকে আর পাঁচটা ট্রেনযাত্রার মতন মনে করেই উঠে পড়েছি। পকেটে কিছু টাকা নিয়ে ভেবেছি নিশ্চয় ট্রেনে খাবার পাবো, প্যান্ট্রি পাবো। কিন্তু এই ট্রেন, এই যাত্রা যে স্বভাবগত ভাবে সম্পূর্ণ আলাদা, সত্যি কথা বলতে সেটা ভাবার সময় পাইনি। তাই এই ভ্রমণের প্রস্তুতিতে আমার গলদ রয়ে গেছে। মাসিমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে এইসব কথা ভাবছিলাম। উনি আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেঁসে বললেন, "এ বেলা আমাদের সাথে ডালভাত খেও।" আর কোনো কথা না বলে, আমার সম্মতি-অসম্মতি জানার সময় না দিয়ে তিনি নিজের কাজে অন্যদিকে চলে গেলেন। বুঝলাম উনি আমার মতামত জানতে চাননি, উনি ওনার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। তাই এ নিয়ে বেশি না ভেবে জানলার বাইরে মনোনিবেশ করলাম।


 

ট্রেনটা এখন কোথায় জানিনা। কিন্তু বাইরের প্রকৃতি একেবারে রুক্ষ; বিহার বা উত্তরপ্রদেশের কোনো অঞ্চল হতে পারে। সামনাসামনি কোনো বড় গাছপালা দেখতে পাচ্ছিনা। বন্ধ্যা, ধূসর অক্ষম জমি অকর্মণ্য-অলস আলস্যে দিগন্ত জুড়ে পড়ে রয়েছে। আরো কত সহস্র, লক্ষ-কোটি বর্ষ পরে হয়তো বা এই মাটিতে প্রানের সঞ্চার হবে। সৃষ্টির বিবর্তনে তখন এই অঞ্চলই সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা হয়ে উঠবে। প্রাকৃতিক অভিযোজনকে সাক্ষী রেখে পাখি-পশু-মানুষের এক মিলনক্ষেত্র তৈরি হবে। কে বলতে পারে তখন আমি হয়তো নবজন্ম লাভ করে এখানে এক কৃষক হয়ে জন্মাবো। একটি ছোট্ট সুন্দর সংসারের মুখে হাঁসি ফোটাতে সারাদিন মেহনত করে একটুকরো জমিতে স্বপ্ন ফলাবো। হঠাৎ এক তীব্র চিৎকারে সেই সোনার স্বপ্ন খান খান হয়ে গেল। কিছুক্ষণ সময় লাগল কি হচ্ছে বুঝতে। কামরার ভিতর একসাথে বহু মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কি চলছে বোঝা খুব মুশকিল। কামরার সবাই নিজের নিজের জায়গা ছেড়ে গোলমালের জায়গাটি ঘিরে ধরেছে। আমিও জায়গা ছেড়ে উঠলাম, কিন্তু এত চিৎকারে বিতন্ডার মধ্যে আসল কারণটা বুঝে উঠতে পারলামনা। দুটি পুরুষমানুষের মধ্যে কথাকাটাকাটি চলছে, তার সাথে এক মহিলার গলাও পাওয়া যাচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে দুয়েকজনকে সরিয়ে একটু সামনে এগোনোর চেষ্টা করলাম। ভিড় কিছুটা ফাঁক হতে ভিতরে সেই বাবাজি আর তার সাধন সঙ্গিনীটিকে দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে বাবাজি দুহাতে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে আমার দুহাত ধরে কাতর স্বরে বললো, "বাবু আপনি শিক্ষিত ভদ্রলোক, আপনি বিচার কইরা দ্যান- আমরা ভিখারি মানুষ, ভিখ মেঙে খাই, যেদিন ভিক্ষা জোটেনা একবেলা খাই, অনেকদিন কিছুই জোটেনা, ভগবানের নাম করে জল খেয়ে শুয়ে পড়ি। আর আজ এই একফোঁটা ছেলে আমাকে চোরের বদনাম দিচ্ছে।" এই বলে ভদ্রলোক হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন। এতক্ষন লোকজন আমাকে দেখেছে আর সম্ভ্রমের সঙ্গে কিছুটা জায়গা ফাঁকা করে দিয়েছে। ফলে আমি ঘটনার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছতে পারলাম। বাদী-বিবাদী আমার দুদিকে। এবার বাদীও আমাকে বিচারের দায়ভার নিতে অনুরোধ করলো। ছেলেটিকে আগে আলাদা করে নজর করিনি; কুড়ি-একুশ বছর বয়স, শ্যামলা গায়ের রং, চুলের বাহার আছে তবে চোখ দুটি খুব উজ্জ্বল। আমি এজলাস চালানোর মেজাজে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, "তোমার অভিযোগটা কি?"


যেটা জানলাম, ছোকরাটির ঝোলা থেকে তার শখের হাতঘড়িটি চুরি গেছে, আর উনি সন্দেহ করছেন এই হাতসাফাইয়ের কাজটি বাবাজি করেছেন। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, এই সন্দেহের কারণ? ছেলেটির বয়ান শুনে এটা বোঝা গেল- কিছুক্ষণ আগে ছেলেটি জামাকাপড় এবং ঘড়িটি ছেড়ে টয়লেটে গিয়েছিল। যখন ঘড়িটি খোলে তখন বাবাজির সঙ্গে তার চোখাচুখি হয়, এবং তার মতে বাবাজির চোখের দৃষ্টি তার ভালো লাগেনি। সেজন্য সে পিছন ফিরে ঘড়িটি জামাকাপড়ের ব্যাগের মধ্যে রেখে দেয়। এখন টয়লেট থেকে ফিরে ঘড়ি পরতে গিয়ে দেখে ঘড়ি নেই। তার তখনই বাবাজিকে সন্দেহ হয়েছিল। এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস বাবাজির তল্পিতল্পা তল্লাশি করলেই ঘড়ি বেরিয়ে পড়বে। একথা বলতেই বাবাজির সাধনসঙ্গিনী ছেলেটিকে প্রায় মারতে এল, এটা দেখে আরেক মহিলা যোগিনীর চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর শুরু হয় শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই। গোটা কম্পার্টমেন্ট তোলপাড় শুরু হল৷ আমি ছিটকে সরে এলাম, চিৎকার-চেঁচামেচি, গালাগাল, হুমকি-প্রতিহুমকির চোটে সারা কম্পার্টমেন্ট মুহূর্তের মধ্যে নরক হয়ে উঠলো। আমি প্রমাদ গনলাম, হঠাৎ করে আমাকে এবং উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে আমার মধ্যে থেকে কেউ প্রচন্ড জোরে ধমক দিয়ে উঠলো, "থামো, একদম থামো। কেউ চিৎকার করবেনা, কারোর মুখ থেকে আর একটাও খারাপ শব্দ শুনতে চাইনা। এরকমভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করলে এক্ষুনি ট্রেন থেকে নামিয়ে দেব। মনে রেখো আমি সরকারের লোক।" কেন বললাম, কে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল, এরকম মিথ্যাচারের তো কোনো প্রস্তুতি ছিলোনা। কিন্তু এখন এতসব ভাবার  অবকাশ নেই; আমার গর্জনে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সবাই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ভয় ও সমীহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি এবার গলা নামিয়ে সবাইকে যার যার জায়গায় ফিরে যেতে বললাম। সবাই সরে গেল, কম্পার্টমেন্টে পূর্ণ স্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো, এমনকি বাচ্ছাগুলোও খেলা ভুলে ভয় পেয়ে বাবা-মার কোল ঘেঁষে বসে পড়েছে। আমি সবাইয়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে অকারণে গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললাম, "যে ঘটনাটা ঘটে গেছে সেটা খুবই দূর্ভাগ্যজনক। এখানে আমরা সবাই মিলে একটা পরিবার। সেখানে চুরি-ছিনতাই ইত্যাদি ব্যাপার চলতে পারেনা। আমি দুজনকেই বলছি নিজের জিনিসপত্র ভালোভাবে খুঁজে দেখতে। বিকেলবেলা আমি দুজনের সাথেই আলাদা আলাদাভাবে কথা বলবো। আশা করি তখন দুজনেই সত্যি কথা বলবে। একটা সুযোগ দেব, কিন্তু যদি কেউ ইচ্ছে করে মিথ্যা কথা বলে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করে তাহলে মিথ্যে ধরা পড়ার পর আমি যে শাস্তি দেব সেই শাস্তি তাকে মাথা পেতে নিতে হবে।" এই বলে সটান নিজের সিটে ফিরে এলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি সেই অসুস্থ ভদ্রলোক নির্নিমেষে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, দু চোখে যেন একটু মিটিমিটি হাঁসির ঝলক।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ