সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে : পর্ব ২


 নন্দিনী সেন

বৈরাগী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে তো ঠিক আমাদের মতো লাগছে না ভাই, তুমি এই ভিড়ে কি করছ?" আমি প্রথমে কি বলব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তারপর একটু ভেবে বললাম আমিও আপনাদের সহযাত্রী। কিন্তু মনে হল উত্তরটা ঠিক মনঃপূত হলো না। না হওয়ারই কথা। সত্যি আমি তো এদের মতো বাধ্য নই। নিছক কৌতূহলবশতঃই চলে এসেছি। বৈরাগী যেন আমার মনের কথা পড়তে পেরেছে। সে বলল এই পথ মোটেই সহজ পথ নয়, তোমার মত আপাতসুখী মানুষের পথ এটা নয়। আমরা পরিযায়ী পাখীর মতো, সংসার ধর্ম ছেড়ে, আরামের জীবন ছেড়ে এই বৈরাগীর জীবন বেছে নিয়েছি। ইশ্বর যেমন যে পথে চালনা করেন আমরা সেই পথে চলি, সেটাই আমাদের গন্তব্য। দেখি সেখানে ভগবানের কি উপহার আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এই বলে আবার গুনগুন করতে করতে নিজের ভাব জগতে ঢুকে পড়ল আর আমিও আস্তে আস্তে সেখান থেকে সরে নিজের জায়গায় চলে এলাম। ট্রেন তার গতি বাড়িয়ে এগিয়ে চলছে। আমি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছি। বাইরে গভীর অন্ধকারে কিছুই নজরে আসছেনা। তবু যেন নতুন কোনো আলো দেখার একটা অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মনে মনে কবির গানের একটা লাইন "আরো কত দূরে আছে সে আনন্দ ধাম " গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম। সত্যি কি এমন কোনো আনন্দ ধাম আছে! যার উদ্দেশ্যে আমরা সকলে চলেছি।

 

গৌতম সরকার

রাতের দূরপাল্লার ট্রেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। সন্ধ্যের চিৎকার-চেঁচামেচি, শিশুদের খুনসুটি আস্তে আস্তে কমতে থাকে, তারপর ঝুপ করে কখন যেন চারপাশ নিঃঝুম হয়ে যায়। আশপাশে কেবলমাত্র কিছু গভীর নিঃশ্বাসের গম্ভীর উপস্হিতি। সামনের সিটের মাসীমাও সিটের পিছনে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর স্বামী তার কোলে মাথা দিয়ে শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছেন। অন্ধকারের মধ্যেও দূর থেকে তার বুকের অস্বাভাবিক ওঠাপড়া নজরে আসছে। এখন আর করার কিছু নেই, জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলে এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার যেন গিলে খেতে আসছে। তবু ভয় জয় করে তাকিয়ে থাকি সেই মহা রাক্ষসীর দিকে…..৷ দূরে কোথাও এক আলোকবৃত্ত যেন দেখা যাচ্ছে, ভালো করে চোখ কচলে তাকালে বৃত্তটা যেন একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ট্রেনের দুলকি চালের সাথে বৃত্তটাও নাচতে শুরু করলো, আর ঠিক সেই সময়ে একটা প্রবল ঝাঁকুনি খেলাম, আর সেই ঝাঁকুনিতে আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম একেবারে সেই বৃত্তের মাঝখানে৷


একটা বড় খেলার মাঠকে ঘিরে অনেক দর্শক, আর মাঠের মাঝখানে এগারো এগারো বাইশ জনের বল দখলের লড়াই, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম স্ট্রাইকার পজিশনে। হঠাৎ একটা বল দূর থেকে উড়ে এলো, আমি আলতো করে বুকে রিসিভ করে পায়ে নিলাম, চকিতে গতি বাড়িয়ে বিপক্ষের দুজনকে কাটিয়ে ওদের গোলবক্সের কাছে পৌঁছে গেলাম, মাঠের দক্ষিণ দিক থেকে আমার নাম ধরে চিৎকার, তারমধ্যে আমাদের গেমস টিচার প্রবোধবাবুর গলা সবার ওপরে৷ স্পষ্ট শুনতে পেলাম উনি নির্দেশ দিচ্ছেন, "আরেকটু ডানদিকে, ডানদিকে ঢুকে বলটাকে ডায়গনালি বক্সের মাঝামাঝি রাখ, দ্যাখ পল্টু সেন্টার ব্যাক থেকে উঠে আসছে।" আমি ডানদিকে ঢুকে হালকা ইনসাইড ডজে ওদের ক্যাপ্টেন শ্রীপতিকে মাটি ধরালাম, তারপর বাঁদিকে একটু সরে এসে স্যারের নির্দেশের তোয়াক্কা না করে জমি ঘেঁষা শটে বলটাকে সেকেন্ড বারের কোনা দিয়ে গোলে ঢোকালাম। চারদিকে "গোল, গোল" চিৎকারে কানে আঙুল দেওয়ার জোগাড়। বাঁধভাঙা আনন্দে পিলপিল করে দর্শক মাঠের ভেতর ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পা মাটির স্পর্শ পেলনা, সবথেকে আগে আমাকে কাঁধের ওপর তুলে নিলেন প্রবোধ স্যার। 


ছোটবেলায় খেলাধুলা, পড়াশোনা সবটাই আমি করেছি। কিন্তু কোনোটাই ফার্স্ট হওয়ার জন্য নয়। ভালো লাগলে করেছি, ভালো না লাগলে জোর করেও কেউ আমাকে দিয়ে করাতে পারেনি। আমার বাবা-মায়ের জীবনের দুঃখ-কষ্টের একমাত্র কারণ আমি। আমার অন্যান্য ভাইবোনেরা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, সেই তুলনায় আমি ভবঘুরে, খ্যাপা-পাগলা একটা মানুষ। বাবা ছিলেন সরকারি আমলা, দাপটের সাথে চাকরি করেছেন। কত বাঘা বাঘা অফিসারদের ওপর হম্বিতম্বি চালিয়েছেন। কিন্তু বাড়িতে আমার ব্যাপারে ডাহা ফেল-- আ বিগ জিরো! এ ব্যাপারে উনি চিরদিন মাকেই দায়ী করে গেছেন। মা ছিলেন নির্ভেজাল গৃহবধু, সবাইয়ের সমস্ত রকম আদেশ, আবদার, অত্যাচার সহ্য করে উনি সর্বংসহা। আমার ব্যাপারে বাবা যখন উষ্মা প্রকাশ করে দোষারোপ করতেন তখন উনি প্রথম প্রথম মৃদু স্বরে বলতেন, "সবাই তো সমান হয় না।" প্রবল ধমকানিতে ওনার গলার আওয়াজ তলিয়ে যেত, পরে আর কোনোদিন বাবার কাছে আমার হয়ে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেননি। শুধু সেই সময়গুলোতে নীরবে চোখের জল ফেলতেন। আমার সমস্ত দৌরাত্ম, গোয়ার্তুমি এক লহমায় নস্যাৎ হয়ে যেত মায়ের চোখে জল দেখলে। বুকটা মুচড়ে উঠত, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, এবার থেকে সব কিছু ঠিকঠাক করে করবো, মাকে কষ্ট দেবোনা। তারপর দুদিনের মধ্যে কোথায় ভেসে যেত সেই সব প্রতিজ্ঞা। গ্রাজুয়েশন শেষ করে যখন চাকরিবাকরির চেষ্টা না করে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, বাবা সেটা আর সহ্য করতে পারলেননা। রিটায়ারমেন্টের কয়েক বছর পরই সিভিয়র সেরিব্রাল অ্যাটাকে চিকিৎসার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন। তারপরও আমার ছন্নছাড়া জীবনে কোন ছন্দ আসেনি। মা বহু চেষ্টা করেছিলেন কোনো এক নারীর সাথে আমার জীবনটাকে বেঁধে দিয়ে আমার যাযাবরী জীবনে ঘরবসত বসাতে। মা যতদিন ছিলেন পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিনা কেন মায়ের জন্যে মনখারাপ করতে শুরু হলে একছুট্টে মায়ের কাছে চলে আসতাম। কিছুদিন হল মা আমাকে সেই পরিশ্রম থেকেও মুক্তি দিয়েছেন। এখন আমি পুরোপুরি মুক্ত, স্বাধীন, কোনো পিছুটান নেই, নেই কারো কাছে ফিরে যাওয়ার মনখারাপের দুপুর, বিমর্ষ সন্ধ্যা, যন্ত্রনাবিদ্ধ রাত্রি। তাই আমি অতি সহজেই চড়ে বসি এই অনিশ্চিতপুর গামী রেলগাড়িতে। যদিও জানিনা এ যাত্রার শেষ কোথায় !

 

নন্দিনী সেন

আসলে একটা কথা আছে না, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝেনা, আমার অবস্থাও অনেকটাই তাই। যখন মা ছিল তখন মায়ের ভালোবাসা, বলা ভাল, ভালোমানুষির বিশেষ মূল্য দিইনি। সবসময় ভেবেছি এটাই তো মায়ের কাজ। মায়ের চাওয়া-পাওয়া নিয়েও মাথা ঘামাইনি। সর্বদা নিজের খেয়াল খুশি মতো চলেছি, একবারও মনে হয়নি আমার এই বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার জন্য মা কে কত সময় আত্মীয়দের সামনে কত কটুকথার সন্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু যেদিন মা চলে গেল সেদিনই বুঝলাম মা আমার জীবনে কতটা জুড়ে ছিল। কিন্তু তখন ভাবা ছাড়া আমার হাতে আর কিছু নেই। তাই আজ আবারও মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আজ এই অনিশ্চিতের যাত্রাপথে কেন জানি না মায়ের কথা মনে পড়ছে। এই আজ যে আমি বেরিয়ে পড়েছি, কোথায় যাচ্ছি, কবে ফিরব তা নিয়ে কারোর কোন মাথাব্যাথা নেই। সবাই তাদের কর্মময় জীবনে ব্যস্ত। আমার মতো অকর্মণ্যের জন্য সময় নষ্ট করার সময় কোথায়? আমি কি কোনোদিন মায়ের কথা ভেবেছি? তাহলে? আমরা সবাই বড় স্বার্থপর। এইসব ভাবতে ভাবতে ট্রেনের দুলুনিতে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা গোঙানিতে তন্দ্রা কেটে গেল। দেখলাম সামনের সেই ভদ্রলোকের বুকটা কেমন যেন হাপরের মতো ওঠা নামা করছে। বুঝলাম ওনার আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। আমি একটু এগিয়ে গেলাম, দেখলাম ওনার স্ত্রী পরম মমতায় ওনার বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে করুন হেসে বললেন যত রোগ সব কি গরিবেরই হয়? আমি কি বলব? বুঝতে না পেরে চুপ করে আবার নিজের সিটে ফিরে এলাম। ভাবলাম যে রোগহীন, মৃত্যুহীন অনিশ্চিতপুরের দিকে এগিয়ে চলেছি সেই জায়গা যদি সত্যি জ্বরা, ব্যাধিহীন হয় তাহলে ওখানে গেলে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবেন আর ভদ্রমহিলার এই মনখারাপ করা মলিন হাসি আনন্দের হাসিতে পরিনত হবে। “জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে"৷

 

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ