সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে [পর্ব-০১]

                                          


লেখা- নন্দিনী সেন এবং গৌতম সরকার

[মুখবন্ধ: করোনা কবলিত বদ্ধ জীবনে কিছুটা একঘেয়েমি কাটানোর জন্যেই এই গল্প গল্প খেলাটি আমার প্রিয় বন্ধু এবং বেরিয়ে পড়ার সঙ্গী শ্রীমতী নন্দিনী সেনের সাথে শুরু করেছিলাম৷ ওনার আন্তরিক আগ্রহ ও সহযোগিতায় লেখাটি বেশ কয়েক পর্ব চালাতে পেরেছিলাম৷ একটা সময় পর সাংসারিক দায়ীত্ব এবং বাহ্যিক কাজের চাপে উনি এগোতে অপারগ হয়েছিলেন৷ তবে একথা অনস্বীকার্য ওনার ঐকান্তিক উৎসাহদান পরবর্তী সময়ে আমাকে লেখাটি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে৷ সম্মাননীয় সম্পাদকের সৌজন্যে লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার অনুমোদন পেয়েছে৷ সম্পাদকমন্ডলীকে আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে অজস্র ধন্যবাদ। আমরা যে যে অংশটি লিখেছি লেখার শুরুতে তার নাম উল্লেখ করা আছে৷]

 

গৌতম সরকার

ট্রেনটা হাওড়া ছাড়লো ২২শে মার্চ সকাল ঠিক সাতটায়৷ আমাদের গন্তব্য অনিশ্চিতপুর৷ এবারের এই ভ্রমনযাত্রা একটু অন্যরকম৷ আমার জীবনে এই ধরণের ভ্রমণের সুযোগ এই প্রথম৷ এর আগে সব জায়গা যাওয়ার আগে পত্রিকা আর গুগলবাবার দৌলতে জায়গাটির হালহকিকত, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, জলবায়ু-বৃষ্টিপাত, নারী-পুরুষের অনুপাত, বিশ্বসুন্দরী-পৃথ্বীসুন্দরীর ইতিহাসে জায়গাটির অবস্থান দেখে ঠিক করতাম জায়গাটি আদৌ আমার মতো উঠতি আঁতেলের পক্ষে ভ্রমণের যোগ্য কিনা৷ সত্যি কথা বলতে কি এবারের বেড়ানোটা যেন কেউ আফিম খাইয়ে আমাকে দিয়ে করিয়ে নিল৷ কোনো এক প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করিয়ে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল--তোমাকে যেতে হবে সেই দেশে যেখানে আকাশ রঙের নেশায় গোলাপি মাতাল, হলুদ ছোপানো ভোরের আকাশে সূর্যোদয় হয় তাবড় শিশুদের সম্মিলিত হাঁসির আওয়াজে, সারা দিন কাটে তামাম মরদের কষ্টিপাথরে কোদাল হেনে, সমস্ত নারী-পুরুষ পরস্পরকে ভালোবাসে, আর শেষ বিকেলের কামরাঙা সূর্য আকাশ-বাতাস দিকচক্রবাল ভরিয়ে তোলে আগমনী আজান গানে হিন্দু-মুসলিম-জৈন-খ্রিষ্টানের আন্তরিক যৌথ নিমন্ত্রনে৷ তাই চলেছি সেই প্রিয় ভালোবাসা জারানো অনিশ্চিতপুরের সন্ধানে৷ দেখতে দেখতে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়লো৷

 

নন্দিনী সেন

আস্তে আস্তে ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে চলল। আমার চেনা শহর ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়তে লাগল। মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে গন্তব্যস্থল নিয়ে। কারন এবারের যাত্রাটা অন্য রকম। মনে মনে যে চিত্র নিয়ে যাচ্ছি তার সাথে কি আদৌ কোন মিল পাবো?  কি জানি কি হবে? না, এই নিয়ে বেশী ভেবে লাভ নেই। এবার একটু অন্য দিকে মন দিলাম৷ জানলার ধারে বেশ ভাল সিট পেয়েছি। সময় কাটানোর জন্য একটা বই খুলে বসলাম কিন্তু মন দিতে পারছি কই! জানলার দিকে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যটাকে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত একটা আগুনের গোলা। সূর্যের এই অপূর্ব রূপ দেখতে দেখতে হঠাৎই কোথায় যেন সূর্যিমামা ডুবে গেলেন। চারদিকে কেমন যেন একটা মন খারাপ করা অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু এভাবে তো চলবে না। অনেকটা রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। একটু চা খেয়ে মন মেজাজটা চাঙ্গা করতে হবে। তখনই দেখলাম কামরার দরজা ঠেলে কেটলি হাতে এক চা ওয়ালার প্রবেশ।

 

গৌতম সরকার

গরম চা হাতে নিয়ে জানলার দিকে ঘুরে বসলাম। বাইরে আলকাতরা অন্ধকার, খুব পরে পরে দেখা মিলছে একআধটা ক্ষীণ আলোর রেখা। কামরাটা পুরো ভরা, মানুষজন আর তাদের জিনিসপত্রে পা রাখার জায়গা নেই। দেখে মনে হচ্ছে ফেরার কোনো আশা না রেখে পার্থিব সব জিনিসপত্র সঙ্গে করে শেষযাত্রার সওয়ারি হয়েছে। এরা কি সকলেই একই পথের যাত্রী? আমার সামনের সিটে বসে আছেন এক বয়স্কা মহিলা, আর তার পাশে আধশোয়া হয়ে গুটিয়ে যিনি পড়ে রয়েছেন, বোধহয় তার স্বামী। দেখেই মনে হচ্ছে অসুস্থ। মাঝে মাঝেই মহিলা কিছু খাইয়ে দিচ্ছেন - দুধ বা জল জাতীয় কিছু একটা হবে। আমি ফিরে বসতেই মহিলার সাথে চোখাচুখি হয়ে গেল, ম্লান একটা হাঁসি ঠোঁটের কোনে এসেই মিলিয়ে গেল। আমি একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "ওনার কি শরীর খারাপ?" মহিলা ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন, ভদ্রলোকের মাথাটা নিজের কাঁধে ঠিক করে রেখে ভিজে গলায় বললেন- “দীর্ঘদিন ধরে সালসা আর ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছেন। আজ বহুদিন চিকিৎসা চলছে, মাঝে মাঝে ভালো থাকেন কিন্তু শীত পড়া আর ছেড়ে যাওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান। ঘরে থাকা এক, আর অসুস্থ লোকটাকে নিয়ে অনির্দেশের পথে বেরিয়ে পড়া… ঈশ্বরের এ কি লীলা! সরকারের লোক এসে বললে, এ দেশে মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে, সরকার থেকে ব্যবস্থা করে তোমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে অনিশ্চিতপুর, সেখানে রোগভোগের কোনো বালাই নেই”৷ বৃদ্ধা গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, " হ্যাঁ গো ছেলে , পৃথিবীতে এমন দেশ আছে যেখানে রোগবালাই নেই, তাহলে সে দেশে কি মৃত্যুও নেই! এমন দেশ এ ধরাধামে থাকতে পারে?" বৃদ্ধার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই, আমিও তো সেই উত্তরের সন্ধানেই বেরিয়ে পড়েছি এই মানুষগুলোর সাথে অচিনলোকের সন্ধানে। না, সরকার থেকে আমাকে বাধ্য করেনি এই ট্রেনযাত্রায় সওয়ারি হতে, আমি স্বেছায় উঠে পড়েছি চলতি গাড়িতে৷ এখন যদি চেকার এসে প্রশ্ন করে আমি কেন এই গাড়িতে, কার পারমিশন নিয়ে আমি অনিশ্চিতপুরের পানে ছুটে চলেছি, তাহলে আমি ধরা পড়ে যাবো। তখন আমাকে কি মাঝপথে নামিয়ে দেবে! চোখের সামনে দিয়ে ভোরের কুয়াশা ছিঁড়ে কু-ঝিকঝিক নীল রঙা ট্রেনটি আমাকে কাঁদিয়ে অচিনপুরের পথে পাড়ি দেবে! তখন আমি কি করবো! আমি তো পার্থিব সবকিছু ছেড়ে কয়েকটিমাত্র জিনিস সম্বল করে বেরিয়ে পড়েছি অনির্দিষ্টের পথে। নিজের ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, সামনে তাকিয়ে দেখি বৃদ্ধা নিবিষ্ট দৃষ্টিতে আমার মুখের প্রতি ভাঁজ-অনুভাঁজে তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। আমি একটু লজ্জা পেয়ে নড়েচড়ে বসলাম, তারপর তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বিষাদ গলায় বললাম, "জানি না!”

 

নন্দিনী সেন

 ভদ্রমহিলার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। সত্যিই কি এমন কোন দেশ আছে যেখানে রোগ নেই, মৃত্যু নেই, হিংসা নেই। যেখানে মানুষ টিকে থাকেনা, বেঁচে থাকে। এমন দেশের হদিশ কোথায় আছে? নিজের মনে ভাবতে ভাবতে অন্যজগতে চলে গিয়েছিলাম। সম্বিত ফিরতেই দেখি ভদ্রমহিলা কেমন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগলো৷ মনে হলো এই দুর্দিনে কি অলীক চিন্তায় আমি মশগুল। কামরার চারিদিকে তাকিয়ে খুব কষ্ট হলো। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম আচ্ছা এরা কি অপরাধ করেছে? নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিরন্তর সকলকে লড়াই করে যেতে হচ্ছে তার ওপর একই অদ্ভুত অভিশাপ গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করতে চলেছে। এই অভিশাপের হাত থেকে কবে আর কিভাবে মুক্তি সম্ভব? এ তো যেন ছায়ার সাথে লড়াই চলছে। আমাকে কেউ বাধ্য করেনি অনিশ্চিতপুরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এরা তো বাধ্য হয়েছে সেখানে যেতে। এরা নিজেরাও জানেনা কি অনিশ্চিত জীবন অপেক্ষা করছে সেই অনিশ্চিতপুরে।

 

 

গৌতম সরকার

এবার একটু উঠতে হবে, একটু টয়লেট যাওয়ার দরকার। কিন্তু এই জটলা ঠেলে যাওয়াটা একটা যন্ত্রনা। দুই সারি সিটের মাঝখানে এমনকি করিডোরেও মানুষ তাদের জিনিসপত্র নিয়ে বসে গেছে। কোনরকমে একে ডিঙিয়ে ওকে মাড়িয়ে ওয়াশরুমের সামনে আসতে পারলাম। কি ভাগ্যিস টয়লেট আটকে লোকজন বসে নেই! প্রয়োজন সেরে বেরিয়ে পাশের কম্পার্টমেন্টে উঁকি দিয়ে দেখি, একই চিত্র। এই ট্রেনের যাত্রীরা সবাই নিম্নবিত্ত আর গরীব লোকজন। এই বিভীষিকার সময়ে এদের না ছিল খাবারের সংস্থান না বাসস্থানের, কয়েকজনের ঘর থাকলেও তাকে ঘর না বলাই ভালো। সেসব ঘরে কোনো আব্রুর বালাই নেই, যখন তখন আকাশ, আলো, জল, বাতাস বিনা অনুমতিতে বিনা সংকোচে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাই সেগুলোকে ঘর না বলে রাস্তা বললে অত্যুক্তি হয়না। দেশের সরকার এই সব মানুষকে বাঁচার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তুলে দিয়েছে নীল স্বপ্ন মাখা এই রেলগাড়িতে। সবাই যাবে সেই অনিশ্চিতপুরে, সেখানে রোগ নেই, নেই জরা, জীর্ণতা, মৃত্যু....তাই কি! কোন সে রূপকথার দেশের সন্ধানে চলেছে এরা....! এই একবিংশতি শতাব্দীতে যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সমগ্র বিশ্ব শাসন করছে, তখন এই স্বপ্নমুলুকের সন্ধান কোন মহান জাদুকর তার জাদু টুপির ভেতর থেকে বের করে আনলো?

    নিজের জায়গায় না ফিরে এগিয়ে যাই পাশের কামরায়। চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মানুষজন আর তাদের জিনিসপত্র। কেউ কলবল করে কথা বলছে, কেউ পোঁটলা-পুঁটলির ভেতর থেকে খাবার বের করে খাচ্ছে, বাচ্চারা হুড়োহুড়ি ছোটাছুটি করে খেলছে। হঠাৎ আমার সাথে ধাক্কা লেগে একটা বাচ্চা পড়ে গেল, আমি তাড়াতাড়ি হাত ধরে তুললাম, লাগেনি তেমন, তবে বেশ ভয় পেয়ে গেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাঁসতে শিশুমুখের এক স্বর্গীয় হাঁসি উপহার দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার সাথীদের সাথে হুল্লোড়ে মেতে উঠলো। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। আশপাশের মানুষজন একটু কৌতুহল, একটু বিরস দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে লাগলো। বুঝতে পারলাম আমি এদের মধ্যে একটু বেমানান, আমার চেহারা আমার পোশাক কোনোটাই এদের সাথে মিলছেনা। মুখে কিছু না বললেও তাদের চোখের ভাষায় জিজ্ঞাসা ফুটে উঠছে -এই মানুষটা এখানে কি করছে? তাদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি পেরিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। কামরা পেরিয়ে দুটি বগির মাঝামাঝি পৌঁছে দেখলাম এক বৈরাগী দম্পতি মাদুর, কাঁথা-কম্বল বিছিয়ে সংসার পেতে বসেছে, তার সাথে ঢোল-করতাল-একতারা সহযোগে গানের আসর জমিয়ে তুলেছে। আশেপাশে  আসর ঘিরে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন মাটিতেই বসে পড়েছে। বৈরাগী ধৈবতে গান ধরেছে --

"সোনার বাংলাতে যারা মায়া মমতায় 

  ভরা অযাচিত প্রেম দিয়েছিল….

(ও তারা ......সবাই কোথায় চলে গেল৷)

কত শখের বাঁধা ঘর খাঁ খাঁ হলো…..

 আজ সম্মুখে অকুল পাড়ি, পিছনে কিছু নাই।

.....................................................

.....................................................

ভাঙা গড়া নিত্য খেলা সবই হলো শেষ

একা আমি বসে কাঁদি হারিয়ে স্বদেশ।"

    চোখ বুজে একমনে গান গেয়ে চলেছে বাউল, একতারাটি তার সাথী, পাশে সাধনসঙ্গিনী ধুয়ো দিচ্ছে আর ঢোলে তাল ঠুকছে। আমার পা দুটো আঠা দিয়ে কে যেন আটকে দিলো। আমি মুগ্ধ আবেশে অচিরে গানের গভীরে ঢুকে গেলাম। কি সহজ কথা আর সুরে 'ভবা পাগলার' ব্যঞ্জনাধর্মী গানটির মধ্যে দিয়ে তাবড় সহযাত্রীদের মনের অবস্থাটা ব্যক্ত করে চলেছে। গান শেষ করে চোখ খুলতেই আমার সাথে চোখাচোখি হলো। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে অপলক চোখে চেয়ে মুখে মৃদু হাঁসি এনে আমাকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। আমি দ্বিরুক্তি না করে তার পাশে বসে পড়লাম৷

                                                             ( ক্রমশঃ….)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ