আশিক মাহমুদ রিয়াদ
সন্ধ্যেবেলায় বাসায় ফিরেছি। সারা শরীরে ভেজা। মাঠে ফুটবল খেলে নদীতে গোসল করে এসেছি। সে বয়সে নদীতে ডুবাতে ভয় পেতাম না। নদীটি খরস্রোতা না হলেও নদীর মোহনা চোখে পড়তো। এই নদী নিয়ে মানুষের কত কল্পকাহিনির প্রচলন আছে। আব্বুকে দেখলাম তিনি মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছেন। তিনি আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। আশেপাশে কিছু একটা খুঁজলেন। না বোঝার অবকাশ পেলাম না।তিনি হাতের কাছে পেলেন গরুর গুইচ্ছা। যেটি দিয়ে গরুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পুতে রাখা হয়। তিনি আমার দিকে তেড়ে এলেন। আমি ভোঁ ছুট দিলাম।খোয়ায় পাঁ কেটে গেলো বোধয়। তবুও থামলাম না । এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে।এখন একটু শান্তি পাওয়া গেলো। তিনি এখন আর বাড়িতে আসবেন না। তিনি নামাজে যাবেন। নামাজের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে।
রাতে তিনি আমাকে নিয়ে বসতেন। কড়কড়ি ভাবেই বসতেন। আমার লেখাপড়ার প্রতি প্রবল অনীহা। লেখাপড়া যেন চিরতার রস। শুধুই তেতো। তিনি আমাকে ধরে ধরে আর্টিকেল,টেন্স, নাউন,প্রো-নাউন বুঝালেন। রাতে তার পাশে খেতে বসালেন।
খাওয়ার আগে তিনি পিটে গোটা কয়েক কিল মারলেন। কলজে নড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে দিলাম। মা আহ্লাদী গলায় আব্বু ধমকের সুরে কিছু একটা বলতে গেলেন। বাবা তাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি গলার আগুন ঝাড়লেন।
২.
কয়েকটা রাত অভিমান করে আব্বুর কাছে ঘুমাতে গেলাম না। আমার বাবা অনেক শাসন করে। রাতে চোখ মেলে অন্ধকারে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে ভাবতে রইলাম আরো ডানপিটে কিভাবে হওয়া যায়।
মান অভিমান শেষে আব্বুর কাছে ঘুমতাম।আবার ফুটবল খেলতাম মাঠে। আব্বু সামনের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাকে ডাকতেন। আমার সাথে তার দূরত্ব থাকতো ১০ ফিট। তিনি আমাকে বললেন,'উঠে আয়। এই বৃষ্টিতে খেলিস না। ' আমি শুনলাম না। বললাম,'ম্যাচ শেষ হতে এখনো অনেক সময় বাকি। ' সে বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেললাম। শরীরে জ্বর বাঁধিয়ে ফেললাম।এই জ্বর গড়ালো টাইফয়েড পর্যন্ত। শরীর বেশি খারাপ ছিলো বলে আম্মার সাথে ঘুমালাম। এক রাতে আমার প্রচন্ড জ্বর উঠলো।শরীর কাঁপতে লাগলো। এত শীত করতে লাগলো যে আম্মা আমার এমন অবস্থা দেখে পুরো তোষক সমেত বিছানা আমার গায়ে তুলে দিলেন। তাও শীত কমলো না। কোন মতে রক্ষা পেলাম। নলীর মতো শরীর শুকিয়ে বাঁশের কঞ্চি হয়ে গেলো। তবুও দুরন্তপনা ছাড়লাম না। আব্বুর পিছন পিছন গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তাম নদীর ভরা জোয়ারে তিনি আমাকে দেখতেন না। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠে পড়তাম।
আমার থিওরি- ডুবাইলে জ্বর কেন, জ্বরের বাপও থাকবে না।
৩.
বাবার কি একটা অসুখ হলো। তিনি রাতে ঘুমাতে পারতেন না। মাথার অসহ্য যন্ত্রণা। আমি ভয় পেতাম। রাতে তার আর্তনাদে আমার ঘুম ভেঙে যেত। তার মাথার ব্যথা পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা।
একপর্যায়ে তিনি ঢাকায় গেলেন চিকিৎসা করাতে।ফিরলেন ক্যান্সার নামক ভয়াবহ রোগের নাম শুনে। সবার চোখে মুখে আতংক। আত্মীয়স্বজন তাকে স্বান্তনা দিতো। বাবা আমাকে ধরে কাঁদতেন। হুঁ হুঁ করে কাঁদতেন। আমি বাবাকে সান্ত্বনা দিতাম। হয়ত তখন থেকেই নিজেকে শক্ত করতে লাগলাম।
আব্বু মারা গেলেন যেন হঠাৎ করেই। আমি বুঝতে পারলাম না কি হয়ে গেল। শক্ত করলাম নিজেকে। মা কাঁদছেন। আমি কাঁদতে পারছি না। আমার চোখে কি এক ফোঁটাও জল নেই? নাকি আব্বুই আমাকে শক্ত করে রেখে গিয়েছেন? বড় খালু ছোটাছুটি করলেন।
আব্বুকে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের বাড়িতে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফণ। আব্বুকে নিজের হাতে সাড়ে তিন হাতের ঘরে রাখলাম। আমি তখনও বুঝতে পারছি না।আমি কি হারিয়ে ফেলেছি। আব্বুর কবরে শেষ মাটি টুকু দিতেই আমার বুকে তীব্র কষ্ট হতে লাগলো। এখানে যে সমাহিত হয়েছেন,আর যার কবরে আমি মাটি দিয়েছি তিনি আমার আব্বু। যাকে জড়িয়ে ধরে আমি কত ঘুমিয়েছে।
বাড়িতে ফিরে কাঁদলাম। হুঁ হুঁ করে কাঁদলাম।
দিন যত গড়ালো আমার বুকে বেদনার পাথরটি আরো বড় হতে লাগলো। আমি এখনো রাত জাগি। জেগে জেগে আব্বুর কথা ভাবি।
তার ছবি দেখি,বুকে কষ্ট লুকাই। চোখ ভিজে আসে। কাঁদতে পারি না। চোখের জলের অস্পষ্ট ঝাপসা দৃষ্টিতে তার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। কি অদ্ভুৎ মায়া!
0 মন্তব্যসমূহ