টুকরো অভিমান
সাবিকুর সিফাত
বাবার উপর টুকরো অভিমান জমে আছে।
স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে সেই কবে।ক্লাস ওয়ানে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস টু তে এখন আমি।কি সেই কঠিন কঠিন পড়া।কি কঠিন অংক,কি কঠিন ইংরেজি,বাংলাও কি কম নাকি।একটা নৌকা বানিয়ে দেবার আর মেলায় হাতীর পিঠে চরাণোর লোভ দেখিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে তা এক বছর শেষ।মেলাও কবে শেষ হয়ে গেলো।হাসান,রাতুল,জয় ওরা সবাই হাতীর পিঠে উঠছে।এসে গল্পও বলেছে।কিন্তু বাবা এখনও নেয়নি আমাকে মেলায়।
অভিমান ভাঙানোর জন্য বাবা আজকে ফন্দি করছে।আমাকে নিয়ে কাঁচামিঠা আম পারবে।আমার কাঁচামিঠা আম পছন্দের তাই।একথা শুনতেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।তারপরেও একটা
গম্ভীরর্যতা ধরে রাখলাম মুখে।
'বাবারে আমি গাছে ওঠার পরে তুমি ব্যাগ বান্ধা রশিটা টান দেবা।তারপর আমগুলা ঢাইলা রাখবা ব্যাগ দিয়া ঠিকাছে?'
আমি বলি, না কিছু ঠিক নাই।ঢালব না,মেলায় না নিলে কিচ্ছু করব না।
তারপর মুখ টিপে টিপে হাসি।
বাবার সাথে একহাটু সমান পুকুরে নেমে আম কুড়াই পানির মধ্যে।
তাতেও অভিমান কমে না আমার।বাবা নৌকায় করে নিয়ে যায় আমাদের সেই অনেক দূরের সবজি ক্ষেতে।তারপর বাবা আমাকে কাঁধে নিয়ে ছোট পানি ভর্তি খালটা পার করে।তারপর সবজি তুলি আমরা।
হঠাৎ বাবার বুকে ব্যথা শুরু হয়।বাবা শুয়ে পরে এক পাশে।আমাকে বলতে থাকে,'বাবা,ও বাবা,বাবারে আমাকে পানি দেও একটু।পানি খাবো একটু।ও বাবা,বাবা…'
হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায় আমার। লাফ দিয়ে উঠে যাই।কে যেন পা ধরে টানছে পানি খাবে।আমি ঘেমে আছি এই শীতের মধ্যেও।
তারপর এক দৌড়ে খালি জগ নিয়ে পানি আনতে যাই কলে।পাগলের মত দৌড়াতে দৌড়াতে ধাক্কা খেয়ে পরে যা্ই।
তারপর তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আব্বার পাশে চুপচাপ দাড়াই।ছোট মশারির ফাঁক দিয়ে বড় বড় চোখ করে খুঁজতে থাকি আব্বাকে।খুঁজতে খুঁজতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।কান পেতে একমনে শুনতে থাকি আব্বা শ্বাস ছাড়ছেন আর নিচ্ছেন। আরামে ঘুমুচ্ছেন।
আব্বাকে ডাকার সাহস হয় না আর।কিন্তু আমার নাছোড়বান্দা মন যে আব্বাকে একটা ডাক দিতে চায়,আব্বা এখনি উঠে বুকে চেপে ধরে বলুক কি হইছে বাপজান আমার। থাক ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।
খাটের নিচ থেকে জলচকিটা টেনে বসে থাকি।তারপর কখন যেন তন্দ্রা লেগে যায়।
ফজরের নামাজ পরতে উঠে আব্বা ডাক দেন ,তন্দ্রা কেটে যায়।হেরিকেনের আলোটা জ্বালাতেই তার চোখে পরে আমার ফেটে যাওয়া পায়ের নখটা।আব্বা শিউরে উঠেন।গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল হয়ত,জমাট বেঁধে আছে রক্ত।অথচ আমি তখন কিছু টেরই পাইনি।
কি অদ্ভুত!
আব্বা বলতেছেন,' কি হইছে বাপজান?'
আমার চোখ ফেটে প্রবাহিত হয় জলস্রোত।সে জলস্রোত থামে না কিছুতে।
আব্বা বলে,'পায়ে মারাত্মক ব্যথা, না বাপজান?'
'আমি কিভাবে বলি আব্বা পায়ের ব্যথার থেকেও যে তোমার জন্য মনটা জুইড়া ব্যথা চলে।
কলিজা পুইড়া যায়।চিৎকার দিয়া আবার বোবা হইয়া যায় মনটা।তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছাইতে পারি না সেই চিৎকার আব্বা।একবার মুখ খুইল বলতে পারিনা আব্বা কেন চোখ দিয়ে টপটপ কইরা পানি পরে।
হ আব্বা,খুব খুব খুব ব্যথা।'
স্বরূপকাঠি,পিরোজপুর।
0 মন্তব্যসমূহ