ফারিয়া ফারজানা অরনী
বৃহস্পতিবার রাত ৮টা। আজকে এত আগে আগে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে পেরে মন ভাল সৌমিকের। রোজ রোজ অফিস যে ইউনিভার্সিটি লাইফের থেকে বেশি প্যারা এটা ভালোই টের পাচ্ছে এখন। একটা দিন ছুটি যেন মরুর বুকে বৃষ্টি!
ল্যাপটপ অন করে সিরিজ দেখতে বসবে, মা রুমে হানা দিল। সৌমিক জানে মা কি বলবে।প্রায় প্রতিটা দিন এক-ই কথা শুনতে হয়। মা কফির মগটা এগিয়ে দেয়,হাতে একটা খাম।সৌমিক মুখ তুলে তাকায়,"কিসের খাম এটা মা?" হাতে নিতে নিতে সৌমিক প্রশ্ন করে। "খুলে দেখ, ওরা বলেছে "ছেলে"কে নিজ হাতে নাকি এটা খুলে পড়তে হবে, অন্য কেউ যেন না পড়ে আগে,বারবার বলে দিয়েছে।" "কয়দিন পর পর কোথায় থেকে যে এত মেয়ের খোঁজ পাও মা!" বিরবির করে সৌমিক। মা চলে যায় রুম থেকে।
ফাল্গুন মাস পড়েছে। মন উড়িয়ে নেওয়া বাতাস সারাক্ষণ, সন্ধ্যেটায় আরো ভালো লাগে। খামটা খুলে কাগজটা হাতে নেয় সৌমিক। গোটা গোটা সুন্দর হাতের লেখা। কিন্তু অদ্ভুত,কোন নাম-পরিচয় এর বালাই নেই! কাগজটা মেলে ধরে সামনে।
"প্রিয় সাহিত্যিকঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রিয় বইঃ দূরবীন (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) প্রফেসর শঙ্কু ( সত্যজিৎ রায়)
প্রিয় গায়কঃ অঞ্জন দত্ত
প্রিয় কবিঃ জীবনানন্দ দাশ
প্রিয় কবিতাঃ মেঘ বালিকার জন্য রূপকথা (জয় গোস্বামী) প্রস্থান (হেলাল হাফিজ)
প্রিয় ফুলঃ বকুল, বেলী
প্রিয় নায়কঃ উত্তমকুমার, রাজ্জাক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
প্রিয় গানঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত
(আর যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়- হুমায়ুন আহমেদ)
প্রিয় ঋতুঃ বর্ষাকাল (আষাঢ়-শ্রাবণ) আর অগ্রহায়ণ
প্রিয় ডাকনামঃ অরো
প্রিয় রঙঃ গোলাপি, শ্রাবণের মেঘের মত ছাই রঙ, লাল
প্রিয় পাখিঃ চিল, পায়রা
প্রিয় জিনিসঃ ডায়েরি, কাগজ
প্রিয় শখঃ আকাশ দেখা, চাঁদ দেখা, লেখালেখি টুকটাক, গুনগুন গান গাওয়া, রাস্তায় হাটা,বই টই পড়া
পাহাড় নাকি সমুদ্রঃ সমুদ্র (পাহাড়ে যাই নি এখনো)
স্বপ্নের জায়গাঃ রেইনফরেস্ট এর ভেতরে হাঁটা
প্রিয় সুরঃ বাঁশি, ভায়োলিন
প্রিয় রাগঃ ইমন,ভৈরবী
প্রিয় গুটি (দাবা)ঃ ঘোড়া
অপূর্ণ শখঃ নৌকায় শুয়ে ভরা পূর্ণিমায় সারারাত চাঁদ দেখা, সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি, তুমুল বৃষ্টিতে নদীর জলে বৃষ্টিস্নান
**রাতের আকাশে সপ্তর্ষি চেনে এমন মানুষ অগ্রাধিকার পাবে।"
এই পর্যন্ত একটানে পড়ে সৌমিক। আশ্চর্য মেয়ে তো! পাশে একটা চিরকুটও পায়। "এই পর্যন্ত ১২জনকে বিয়ের বায়োডাটায় এই কাগজখানা দেখানো হল। আপনি এখন পড়ছেন মানে আমার এখনো শুভকাজটা হয় নি। যদি এই কাগজটা পড়ে আগ্রহ হয়, শুধুমাত্র তবেই আমাদের নাম-পরিচয় দেখাদেখি হতে পারে।অন্যথায় না করে দিন।অরুণা।"
সৌমিক মা এর সামনে এসে এই প্রথমবারের মতন বলল, কালকে শুক্রবার তো,পাঞ্জাবি টা মানাবে না দেখো তো? মা অবাক হয়ে, "হ্যাঁ মানাবে তো, কিন্তু!" সৌমিক মায়ের হাতে হাতটা রেখে বলে, এই শহরের যান্ত্রিকতার চাপেও যন্ত্র হয়ে যায় নি এমন একটা মানুষের দেখা পেতে যাচ্ছি মনে হয় কালকে,মা। রাত জেগে এস্ট্রোলজির বই পড়া আর তারা গোনা মনে হয় এই প্রথম কাজে লাগতে যাচ্ছে!
......
কলেজ বন্ধ আজকে থেকে। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার শেষে ৫ দিনের ছুটি শুরু আজ। ক্যালেন্ডারে ছুটির তারিখ গুলো মার্ক করতে যেয়েই বাংলা মাস টা-ও চোখে পড়ল শর্মীর। ১৩ই ফাল্গুন আজ। ফাল্গুন মাসটা কি সুন্দর! মনে মনেই বারবার বলতে থাকে।
অনেক পুরনো দিনের কাগজ আর বই একটা ড্রয়ারে রাখা, আজকে সেগুলি-ই বের করা হয়েছে অনেক বছর বাদে। এগুলো নাকি সেই দাদাভাই-দাদিমণির সময়কার! পুরনো একটা ডায়েরি। কালো মলাটের উপর ধুলো জমে ধূসর হয়ে আছে। মুছে নিল শর্মী ডায়েরিটা। প্রথমদিকটায় দু'জনের হাতের লেখা। একটা পৃষ্ঠা দাদাভাই এর হলে আরেকটা দাদিমণির। পরের দিকে শুধুই দাদীর হাতের লেখা।
ডায়েরির কিয়দংশঃ
" শেষমেষ আমি তার বাসায়। নতুন জীবন ভয় ভয় আর সংশয়। ছেলেটা কবিতা এত ভালোবাসে, প্রথম রাতেই জীবনানন্দ নিয়ে বসল। এক হাতে কফির মগ,আরেক দিকে তার হাত, এইজীবনে একসাথে বসে প্রথম চাঁদ দেখা! এই সাতদিনে প্রতিটা রাত সাহিত্য-প্রেমের কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুম আসে। এই সুন্দর সময়গুলো সারাটা জীবন থাকুক। এই মানুষটা এমন-ই থাকুক! -তার 'কাব্যলক্ষ্ণী' "
" এই মেয়েটা ছিল বলেই মন এত ভাল যায়। আজকে ১৩ই ফাল্গুন। এই বিশেষ দিনটার আজকে দুই বছর। কিছুই পরিবর্তন হয় নি আমাদের, এখনো মেয়েটাকে বই এনে দিলে চোখে ঝলমল করে খুশি। বিকেলে হালকা শীত শীত নরম রোদে শাড়ি পড়ে বের হতে নিলেই কি মায়াভরে তাকায়! এই মায়া কখনো না কাটুক, আমার অরুণ-বরুণ এর জীবনে সুখের বর্ষা নামুক। -সৌমিক।"
"এই অর্বাচীন বনে তুমি কোন বনফুল,মাধবীলতা? তোমায় বুকে ধারণ করে, এই গহন বনে তোমার আলোয় নিয়ে এল কি বারতা? কি বারতা? কি বারতা? -সৌমিক।"
"এই অরণ্যে নতুন কুঁড়ি ফুটতে যাচ্ছে। শয়ন-স্বপন প্রাতে পূর্ণ হোক মঙ্গলআলো! -অরো।"
এই পর্যন্ত লেখা। তারপরে অনেক দিনের লেখা নেই কোনো। আবার লেখা শুরু -
"এখন সৌমিক ভীষণ ব্যস্ত থাকে। সেই সকালে অফিস, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয় ফিরতে। হাতে কবিতার বই থাকে না এখন, থাকে বাজারের লিস্ট আর খরচের হিসাব। আমারও ব্যস্ততা, শখের জিনিস করার সময় কই? আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি অজান্তেই। এমন হতে হবে কেন সব? এত সময়হীনতা কেন? কেন নিজেদের দেওয়ার জন্য টুকরো সময় নেই? কেন? কেন? -অরো।"
"আগের মত কবিতা শুনাতে পারি না তোমাকে অরো। জানি অনেকটা দিন অভিমান করে আছো। তিনশ' ত্রিশ বার লিখে রাখলাম ডায়েরিতে " ভালোবাসি" "ভালোবাসি"। বেলীফুলের মালাটাও রাখলাম,জানি তোমার রাগ পড়ে যাবে। -সৌমিক।"
এরপরের দিক অনেকটাই খালি। শেষের দিকে শুধুই অরোর লেখা। "সময় কত বদলে গেল। সংসারের অসংখ্য দায়িত্বে আর কাজে অমোঘ নিয়তি যেন এই ব্যস্ততা। তারপরেও তুমিই তো ছিলে আমার কাব্য-সাহিত্য-প্রেম। তোমাকে কেন চলে যেতে হল? কেন নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়?"
শর্মীর চোখ ভেজে। দূরে কোথায় থেকে যেন গানের সুর কানে আসে।
"আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।"
ফাগুনের উদাস হাওয়ায় উড়তে থাকে মন, দোল খেয়ে যায় সময়!
ফার্মেসি অনুষদ- চতুর্থ বর্ষ ,ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক ।
0 মন্তব্যসমূহ