সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

লাল পাহাড়ের দেশে: ষষ্ঠ পর্ব

ড. গৌতম সরকার

পরেরদিন ভোরে অনেক পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। কিছুটা সময় লাগল কোথায় আছি বুঝতে। কলকাতায় তো এমন পাখির ডাকে কখনও ঘুম ভাঙেনি। একদম ছোটবেলায় এরকম পাখির ডাক শুনতাম। ঘুম ভাঙতে দেরি হলে গাছ থেকে উড়ে এসে জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরেও ঢুকে পড়তো। কোথায় আছি মনে পড়তেই উঠে বসলাম। পবিত্র গভীর ঘুমে, কাল বেচারির অনেক পরিশ্রম গেছে। ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে। বুঝলাম মক্কেলদের ঘুম ভেঙেছে। উঠে ব্রাশ-পেস্ট নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলাম। এই ভরসকালে ওদের মুখোমুখি হতেও অস্বস্তি হচ্ছে, পবিত্র উঠে যা করার করবে। আমার ইচ্ছে সূর্য ওঠার আগেই আশপাশ এক চক্কর ঘুরে আসা। কিন্তু স্নানঘর থেকে বেরোতেই রাজেশ চা নিয়ে হাজির। আমি ইশারায় পবিত্রকে জাগাতে না করলাম। এবার যতীনও পায়ে পায়ে হাজির। দুজনেরই মাথা নিচু। বুঝলাম কালকের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। আমি শুধু এটুকু বললাম, তোমরা কাল খুব অন্যায় করেছ, তোমাদের জন্য ওই স্যারের (পবিত্রর দিকে আঙুল দেখিয়ে) অনেক ভোগান্তি হয়েছে। আমাকে নয়, যা বলার ওই স্যারকে বোলো। আমি চটপট চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

     বাইরে বেরিয়েই চোখের দ্রাঘিমায় যেটুকু দেখলাম সেটা শুধুই জঙ্গল আর টিলা পাহাড়। কাল রাতের অন্ধকারে যেটা বুঝিনি, সেটা হল লালরঙা পলাশ-শিমুলে বনে বনে আগুন লেগেছে। মহুয়া ফলগুলো রসের ভারে ভারী হয়ে খসে খসে পড়ছে; আর ফেটে গিয়ে চারদিকে নেশাগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পূব আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, সূর্য উঠে গেছে তবে পাহাড় পেরিয়ে এপারে আসতে একটু দেরি হচ্ছে। আমি পিছনের পথটা ধরে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা গিয়ে কালকের সেই পাকদন্ডীটা পেয়ে গেলাম। এরপর কিছুটা ডাইনে এগোতেই একটা গ্রামের দেখা মিলল। গ্রাম বলতে পাঁচ-ছটা বাড়ি, কিন্তু জনমানবহীন এই ঘোর জঙ্গলে এটাই মস্ত বড় জনপদ বলে মনে হল। উঠোনে মুরগি খাবার খুঁটে খাচ্ছে, ঘর সংলগ্ন গোয়াল থেকে গরু-মোষের ডাক কানে আসছে। মেয়েরা ঘরকন্না শুরু করে দিয়েছে। একটা বাড়িতে দুমুখো উনানে ধানসেদ্ধ হচ্ছে। বাড়ির বারান্দায় তাকিয়ায় বসে বুড়ো মানুষেরা হুঁকোয় টান দিচ্ছে। আশপাশের মাঠে হালে গরু-মোষ জুতে দিয়ে মাটি ভাঙার কাজও শুরু হয়ে গেছে। 

      গ্রাম পেরিয়ে আবার গভীর বনের হাতছানি। আঁকাবাঁকা কালো পথ জঙ্গলের বাঁকে হারিয়ে গেছে। জঙ্গল একদম পাহাড়ের বুকে গিয়ে শেষ হয়েছে। পাহাড়গুলোও সাজানো ছোটবড় গাছপালা দিয়ে। বেশ কিছুটা সময় ধরে জঙ্গল আর পথের কাটাকুটি খেলা পেরিয়ে উপস্থিত হলাম একটা  উন্মুক্ত জায়গায়। চোখ তুলে তাকাতেই সামনে দেখতে পেলাম সবুজে সাজানো এক প্রশস্ত লেক। এখানে এরকম একটা লেক আছে তাই জানতামনা। লেকের জলে বিভিন্ন জলজ ফুল ফুটে আছে। বাদামী পাহাড় সবুজ গাছপালার প্রেক্ষাপটে লেকের অবস্থানটি সত্যিই অনবদ্য। লেকের জলে আকাশ আর পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি কোনো বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা চিত্রপটের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই জায়গায় দুজনে মিলে আসতে হবে। এবার ফিরতে হবে। এতক্ষন ঘুম থেকে উঠে পবিত্র ছেলেদুটোকে নিয়ে কি করছে ভেবে সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত পা চালালাম।

      হোটেলে ফিরে দেখি পবিত্র একটা চেয়ার নিয়ে ড্রইংরুমের ঠিক মাঝখানে বসে দুজনকে কঠিন গলায় একের পর এক নির্দেশ জারি করে চলেছে। আর ছেলেগুলো নীরবে সেগুলো তামিল করে চলেছে। ওদের সন্ত্রস্ত ভাব দেখেই বুঝলাম সকালবেলায় দাওয়াইটা ভালোই পড়েছে। পবিত্রর ভারী গলার গম্ভীর আওয়াজে আমারই আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাওয়ার জোগাড়, আর ওরা তো সত্যিই অপরাধী। আমি ঘরে ঢোকার পরপরই পবিত্র চড়া গলায় অর্ডার দিল, " রাজেশ.... সাব আ গিয়া, চা লাগাও জলদি।" " যতীন, দেখো বাথরুম মে পানি হ্যায় কি নেহি, নাহানা হ্যায়। নেহি তো তুরন্ত পানি কা ইন্তেজাম করো।" পবিত্র একটার পর একটা হুকুম ছাড়ে, আর দুজন বেচারি দৌড়ে দৌড়ে সেই হুকুম পালন করে। ছেলেদুটোর জন্যে খারাপ লাগছিল, আবার পবিত্র যেটা করছে সেটাকেও ভুল বলতে পারছিনা। সত্যিই তো কাল ওরা যেটা করেছে সেটা ভীষণ অন্যায়। শুধু ড্রিঙ্কস খেয়েছে তাই নয়, খেয়ে বেঁহুশ হয়ে আমাদের রাতের খাবারটা পর্যন্ত দিতে পারেনি। এইকথা যদি মালিকের কানে যায় সঙ্গে সঙ্গে ওদের চাকরি চলে যাবে। পবিত্র তো সেটা করেনি, ও ওর পারসোনালিটি দিয়ে ওদের কর্তব্য বিষয়ে সচেতন হতে শেখাচ্ছে। তুমি যে কাজে নিয়োজিত, তোমার আচরণ সেই কাজের সাথে মিলিয়ে হতে হবে। যতই আমরা তোমাদের বয়সের কাছাকাছি হই, আমাদের অনুপস্থিতে আমাদের জিনিসে হাত দেওয়া তো একরকম চুরির সামিল। পবিত্র তার আচরণ দিয়ে কৃতকর্মের জন্য ওদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগাতে চাইছে। একদিক থেকে একদম ঠিক করছে। এই শিক্ষা ওদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে কাজে দেবে। স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট সেরে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। 

    বাইরে বেরিয়ে পবিত্র আগে একচোট প্রাণ খুলে হেঁসে নিল। সকালে কি কি ঘটেছে, আর ওদের প্রতিক্রিয়া সব ওর মুখে শুনে আমারও হাঁসি পেল। এরপর বেড়ানোয় মন দিলাম। আজ আমরা ঠিক করেছি জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরবো। জঙ্গলের গন্ধ নেব, পাখ-পাখালীর ডাক শুনবো, হয়ত কোনো জংলী-জানোয়ারের সাক্ষাতও মিলতে পারে, আর সর্বোপরি আমাদের সঙ্গে থাকবে শক্তি-সুনীল-শঙ্খ-সুভাষ। ঝোলাতে জল আর ক্যামেরার সাথে সাথে কবিতার বইগুলোও সযত্নে নিয়ে নিয়েছি। এখানকার জঙ্গল তো সমতল নয়! তাই প্রতি মুহূর্তে ঠোক্কর খেতে খেতে হয় উঠতে হচ্ছে, নয় নামতে হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য জঙ্গল শেষের পাহাড়টা। খালি চোখে হাতের কাছে মনে হলেও, যতই হাঁটছি ততই যেন পাহাড় দূরে চলে যাচ্ছে। কিছুটা যাওয়ার পর একটা সমতল মতো জায়গায় পৌঁছলাম, মাথার ওপর শাল-সেগুন মিলে চাঁদোয়া তৈরি করেছে। সূর্যকিরণ আসার কোনো সুযোগ নেই। তবে এপ্রিল মাসের গরমে আমরা বেশ ঘেমে গেছি। এখন এই জায়গাটায় পাতার বিছানায় বসে বেশ আরাম লাগছে। একটু করে জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলাম। ব্যাগ থেকে বেরোল কবিতার বই। তারপর দুজনের উদাত্ত কণ্ঠে কবিতা পাঠে সময় কখন কেটে যেতে লাগল টেরই পেলামনা। অনেকক্ষণ পর চেতনায় ফিরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় এক ঘন্টা পর পাহাড়তলিতে পৌঁছলাম। ঘাড় উঁচিয়ে সেই পাহাড়কেই হিমালয়সম উচ্চ মনে হল। পর্বত লঙ্ঘনের উচ্চাশা না করে ধীরে ধীরে 'যতটা পারি উঠব' মানসিকতা নিয়ে উঠতে লাগলাম। এখানে আর মাথার ওপর কোনো আচ্ছাদন নেই। সূর্যদেব অতি উৎসাহে তার সমস্ত উত্তাপ যেন এই পাহাড়ের মাথায় উপুড় করে ঢালতে শুরু করেছে। এখন ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, কিন্তু সেই বয়সে ওসব আদৌ গায়ে মাখতাম না, আর জীবনের প্রথম বিশটা বছর গ্রামে কাটানোর সুবাদে এসব কষ্ট করার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ে ছোটবড় অনেক গাছ আছে। তাদের ডালপালা ধরে আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম। শুধু পায়ের দিকে একটু নজর রাখতে হচ্ছে। কারণ আলগা পাথরে পা পড়ে গেলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা একশো ভাগ। উঠতে উঠতে প্রায় মাঝপাহাড়ে উঠে এলাম। রোদচশমা থাকায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছেনা, তবে জামা- গেঞ্জি ইতিমধ্যেই ভিজে ঢোল হয়ে গেছে। অর্ধেকটা উঠে পড়ার পর দুজনেই আশাবাদী আরেকটু চেষ্টা করলে পুরোটাই উঠে পড়তে পারবো। আর সেটা করতে পারলে, আমাদের কাছে এভারেস্ট বিজয়ের থেকে কম গৌরবের হবেনা। বিশ্রাম নিতে নিতে, আর কখনো গলা শুকিয়ে গেলে এক ঢোক করে জল খেয়ে উঠতে থাকি। জলও তো নিয়ে বেরিয়েছি এক বোতল, তাই ইচ্ছে করলেও ওই একঢোক খেয়েই ক্ষান্ত থাকতে হচ্ছে। একসময় বহু কষ্ট শেষে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পড়লাম। আর এই চূড়া স্পর্শ করে যে আনন্দ পেলাম সেরকম নির্ভেজাল আনন্দ এখন আর কোনো কিছুতেই পাইনা। সেই বয়সে সব কিছুই পূর্ণ উপভোগ করতে পারতাম। চূড়ায় পৌঁছনো মাত্র দুই কিশোর বালকের আনন্দ চিৎকারে নির্জন বনমধ্যে সাড়া পড়ে গেল। কয়েকটি পাখি ভয় পেয়ে ডাকতে ডাকতে কোথায় উড়ে গেল, নিচের জঙ্গলে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল; হয়তো কোনও বুনো জন্তু আমাদের ডাক শুনে ভয়ানকতম কোনও জন্তুর আগমন ঘটেছে ভেবে ঊর্ধ্বশ্বাসে আরও ঘন বনের দিকে দৌড় মারল। উচ্ছাস কিছুটা কাটতে এবার ছবি তোলার পালা। এখানে তো ছবি তুলতেই হবে। নিজেদের এই বাহাদুরির কথা শতগুন করে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজনদের দেখাতে হবে, শোনাতে হবে। পাহাড়ের মাথাটি সমতল, এবং অনেকটা ছড়ানো। তাই জায়গাটি মন খুলে ঘুরে এবার অন্য দিক দিয়ে নামার পরিকল্পনা করলাম, তাহলে অ্যাডভেঞ্চারটা আরও জোরালো হবে। ঘড়ি জানান দিচ্ছে দুটো বেজে গেছে, ইতিমধ্যে খিদেও পেয়েছে, তাই অবতরণে মন দিলাম৷ ফিরে  রাজেশ-যতীনের বানানো 'লা জবাব' খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিতে বিছানায় আশ্রয় নিলাম।

      চোখটা একটু ধরে আসতেই চটকা ভেঙে উঠে বসি। জানি ঘুমিয়ে পড়লেই এত সুন্দর বিকেলটা একেবারে মাঠে মারা যাবে। বিহারের ওই অঞ্চলে বিকেলের পর থেকে একটা মিঠে হাওয়া বইতে শুরু করে। সারাদিনের দাবদাহ হাওয়ার হালকা ঠান্ডা পরশে নিমেষে দূর হয়ে যায়। আর সূর্য ডোবার আগে থেকে পরিবেশ-প্রকৃতি মেটে সিঁদুরের রঙে রেঙে ওঠে। সেই লালের সাথে লাল মাটি মিশে একটা অপার্থিব দৃশ্যলোকের সৃষ্টি হয়। সেটা মিস করতে চাইনা। পবিত্রকে ঘুম থেকে তুলে, হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সকালের পথ ধরে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম ঝিলের পাড়। গিয়ে দেখি সারা ঝিল জুড়ে অজস্র চেনা-অচেনা পাখির মেলা বসে গেছে। সকালে এদের দেখিনি, এখন তাদের কলকাকলিতে সারা ঝিলপাড় সরগরম। পৌঁছে চুপ করে একটা পাথরের ওপর বসে পাখিদের কান্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। ওদিকে পশ্চিমাকাশে কামরাঙা রঙ ধরতে শুরু করেছে। এখানে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত কোনোটাই মোহময় নয়। কারণ সূর্য উঠে পড়ার বহু পরে পাহাড় টপকে এপারে এসে মুখ দেখায়, আবার অস্ত যাওয়ার বেশ কিছুটা আগেই পাহাড়ের আড়ালে চলে যায়। পাহাড়ের আড়ালে চলে যেতেই অন্ধকার ঘনাতে শুরু করে, বাতাসের বেগ বাড়ে। এই ভরা এপ্রিলেও ঝিলের ধারে বসে একটু শিরশিরে অনুভূতি হতে লাগল। এবার ঝিলের দিকে পিছন করে বসে আকাশের রং বদলের খেলা দেখতে লাগলাম। দূরের রাস্তা দিয়ে মাঝেসাঝে এক আধজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, একদল আদিবাসী মহিলা নিজেদের ভাষায় গান গাইতে গাইতে মাথার এত্ত বড় বড় বোঝা নিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। তাদের গানের সুর শেষ বিকেলের আকাশ সামিয়ানার পরতে পরতে মিশে যাচ্ছে। একটা চোরা নেশা যেন চেয়ে ফেলছে পাহাড়ি ছোট গ্রামটাকে, আশপাশ অন্ধকারে ঢাকা পড়তে শুরু করেছে। সাদা মাটির রাস্তা ধূসর হয়ে উঠছে। এবার উঠতে হবে। ঘন অন্ধকার, জঙ্গলের অদ্ভুত আওয়াজের মধ্যে দিয়ে হালকা হাওয়ায় পাহাড়ের সোঁদা গন্ধের মধ্য দিয়ে টলমল পায়ে হোটেলে ফিরতে লাগলাম।

                          (ক্রমশঃ…….)                                                  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ