সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে: ৭ম পর্ব

 

গৌতম সরকার

অনেকদিন পর আজ আকাশ দেখার অবসর হল। দিনগুলো অতি ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছে। সবদিক সামলাতে সামলাতে আমার মত কর্মহীন একটা মানুষও শত ব্যস্ততার বোঝা কাঁধে নিয়ে অনিশ্চিতপুরের দিকে ছুটে চলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাপারটা খুব উপভোগ করছি। সরকারের লোক বলে ভয়েতে হোক বা ভক্তিতে হোক; কিংবা আমার শিক্ষা, পোশাক, কথাবার্তায় ওরা আমাকে একদিকে গুরুমশাই ঠাউড়েছে, আবার অন্যদিকে সকাল-সন্ধ্যে বিচারের জন্য যাবতীয় সালিশি নিয়ে হাজির হয়ে আমায় বিচারকর্তা ভেবে নিয়েছে। এই কুড়ি বগির ট্রেনে চারটে করে বগি মিলে পাঁচটা কমিটি আছে, আমাকে থাকতে হয়েছে সবকটাতেই। প্রায় প্রতিদিনই দুতিনটে কমিটির সাথে বসতে হয়, নানা সমস্যা, পরিকল্পনা, সমাধান নিয়ে আলোচনা চলে। ট্রেনের বেশিরভাগ মানুষই এখন বিশ্বাস করে সরকার তাদের ভালোই এই ব্যবস্থা করেছে। ট্রেন যত ছুটে চলেছে, মারণ রোগের ভয়-ভীতি, আতঙ্কের স্মৃতি ততই আবছা হতে শুরু করেছে। তারা এখন স্বপ্ন দেখছে সেই অচিনপুরের, যে অচিনপুর তার শোভা-সৌন্দর্য্য, সম্পদ-প্রাচুর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করে আছে তাদের স্বাগত জানানোর জন্য। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি কই! আমার মধ্যের সব সরলতা, সহজিয়া বোধ, স্বপ্ন দেখার চোখ আর রূপকথার মন কখন নষ্ট হয়ে গেছে টেরই পাইনি। মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত বোধ করি, তখন আমার ক্লান্তি কাটানোর একমাত্র সঙ্গী হয় একফালি আকাশ।


নিজের জায়গায় বসে কামরার চারদিকে চোখ বোলাই। সামনের মেসোমশাই চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। মাসিমা নেই, তিনি এখন আছেন এস-টুয়েলভের সেই মেয়েটির কাছে। গতকাল বিকেলে একটা ঘটনা ঘটেছে। একটা মিটিং ছিল এস-সেভেনে। মিটিং চলাকালীন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ হুড়মুড় করে এসে হাজির। ওরা যে সমস্যার কথা শোনাল, সেটারও যে চলন্ত ট্রেনে সমাধানের রাস্তা বাতলাতে হবে সুদূর কল্পনাতেও ছিলনা। প্রথমে সবাই একসাথে কথা বলায় মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আমি একটু ধমকাতেই সবাই চুপ। একটু রেগে উঠে বলি, "সবাই একসাথে কথা বললে, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। আপনাদের মধ্যে যে কেউ একজন বলুন।" এবার সবাই একজনের দিকে তাকালো। চেয়ে দেখি রোগাটে গড়ন, বয়স ২৭-২৮ বছরের একটি ছেলে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে সাংঘাতিক টেনশনে আছে। প্রথমে তো থতমত খেয়ে কিছুই বলতে পারেনা, ভয়ে না টেনশনে বোঝা গেলনা। যেটুকু বোঝা গেল, শুনেই আমার মাথায় হাত। ওই ছেলেটির স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছে। এক্ষুনি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। ট্রেনের মধ্যে এরকম একটা পরিস্থিতি আসতে পারে আমার অর্বাচীন মাথায় আগে আসেনি, আসা উচিত ছিল। ট্রেনে না আছে ডাক্তার, নার্স, না ওষুধপত্র, চিকিৎসার সামগ্রী। মিটিং মাথায় উঠল, বিভিন্ন কামরায় খবর পাঠানো হল, এব্যাপারে কেউ সাহায্য করতে পারবে কিনা। বাইরে থেকে যে কোনো সাহায্য আসবেনা, সেটা সবাই জানে। কারণ, এই ট্রেন আমাদের ইচ্ছেয় থামবেনা, খুব অসহায় বোধ করলাম। যখন কি করা যায় ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিনা, তখন আমার কামরার মাসিমা বিশ্বদাত্রী হয়ে আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। আমার উদ্বেগ দেখে বলেছেন, "তুমি চিন্তা করোনা, আমি কতদুর কি করা যায় দেখছি।" আমি অবাক চোখে ওনার দিকে তাকাতে উনি জবাব দিলেন, "আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও ছোটবেলায় মা-কাকিমার ক্ষেত্রে ধাইমার কাজ কাছ থেকে অনেকবার দেখেছি। আর আমাদের মহিলাদের কিছু কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। তুমি চিন্তা কোরোনা"। তার উপর একজন মহিলার সন্ধান পাওয়া গেল যিনি কোনও এক হাসপাতালে এইসব কাজ করতেন। কাল থেকে দুজনেই ওই মেয়েটির কাছেই আছেন। রাত্রেও মাসিমা ওই কামরাতেই ছিলেন। মাঝে একবার এসে মেসোমশাইকে ওষুধ খাইয়ে আবার চলে গেছেন৷ একটু আগে খবর এল, মেয়েটির একটি ছেলে হয়েছে। মা-ছেলে দুজনেই সুস্থ আছে। মাথা থেকে একটা চিন্তার বোঝা নামল। একটু নিশ্চিন্তি হয়ে জানলার ধারে গিয়ে বসতেই চোখে পড়ল লাজুক একচিলতে আকাশ। 

   কামরাতে দিনক্ষণ ক্যালেন্ডারের হিসেবে হয়না, এখানে দিনরাতের হিসেব কেউ রাখেনা। তাই নীল আকাশের বুকে যখন সাদা মেঘের ভেলাগুলো চোখে পড়ল, তখন স্মৃতির আল্পনা ছুঁয়ে কেউ যেন কানে কানে বলে গেল, এখন শরৎ কাল। মনে পড়তেই কানের মধ্যে 'দ্রিদিম দ্রিদিম' ঢাকের আওয়াজ, কাঁসরের 'টঙ টঙা টঙ' শব্দ বুকের কপাটে ধাক্কা মারে, চোখের সামনে মা দূর্গা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন, শিউলির টুপটাপ খসে পড়ার শব্দ ধৈবত তানে কানের মধ্যে শারদমঞ্জরীর সুর বাজিয়ে চলল। 

    আশপাশে পাঁচটা গ্রাম।মিলে একটাই পূজো। আমাদের বাড়ির সামনে যে কুলতলির মাঠ, সেখানে ম্যারাপ বাঁধা শুরু হত মহালয়ার দিন থেকে। পূজোর গন্ধ যদিও ছড়িয়ে পড়ত তার অনেক আগে থেকে। কুমোরকাকু যেদিন দলবল নিয়ে ঠাকুর একমেটে করতে আসত, সেদিন থেকেই আমাদের ছোটদের পূজোর বোধন শুরু যেত। খবর পেয়েই যে যেখানে থাকতাম একছুটে পৌঁছে যেতাম কুলতলির মাঠে। ওখানেই দুর্গামণ্ডপ, যার সভাপতি ছিলেন আমার বাবা। বাবা স্বভাবে নাস্তিক হলেও, যেকোনো সার্বজনীন পূজোর অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাবার কথা মনে পড়তেই, মা কোথা থেকে চলে এল একদম সামনে। চওড়া লালপেড়ে শাড়ি, সিঁথিতে মোটা সিঁদুর, মাকেও আমার আরেক দূর্গা মনে হত। দশমীতে বিসর্জনের আগে মা যখন এই সাজে সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুরকে বরণ করত, আমি সর ভুলে মায়ের ওই ঐশ্বিক রূপের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মা হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নৃত্যের তালে তালে ঠাকুরদের বরণ করত, অনেকক্ষন সময় লাগত। আমি প্রতিবছর মায়ের বরণ করা দেখব বলে আগেভাগেই সমস্ত বাজি পুড়িয়ে ফেলতাম। জানতাম মায়ের বরণের পরপরই ঠাকুরকে গাড়িতে তুলে বিসর্জনে নিয়ে যাওয়া হবে। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আর কোনোদিন দেবীর মুখ দেখেনি। মনে হয়, আমার রঙিন মা, আমার মহিয়সী মা, আবার পরমাসুন্দরী মা নিজের সাদা বেশ ঠাকুরকে দেখাতে চায়নি, বা ঠাকুরও হয়ত এই ভীষণ রকমের বেরঙিন মাকে সহ্য করতে পারতোনা। আজ বাবা নেই, মা নেই, আমিও নেই, কিন্তু কুলতলির মাঠ আছে, দূর্গামণ্ডপ আছে, মিস্ত্রিকাকু নেই তবে তার ছেলে, নাতিরা মায়ের মূর্তি গড়ার ভার নিয়েছে। সবকিছু নেইয়ের মত আমার ছোটবেলার সেইসব রঙিন আনন্দগুলো কখন যেন মায়ের কাপড়ের মত রঙ হারিয়ে সাদা হয়ে গেল। আর সেখানে সময়ের কালো আঁচরগুলো গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে, বড় কষ্টের, বড় যন্ত্রণার।

   আকাশের দিকে তাকিয়ে অতীতলোকে কতক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিলাম কে জানে! বাস্তবের ভেলার রুক্ষ ঠেলায় আবার কামরার মধ্যে ফিরে এলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি মেসোমশাই আমার দিকে পলকহীন চেয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই মুখে একটা হালকা হাঁসি খেলে গেল। এর আগেও দেখেছি মেসোমশাই হাঁসলে আগে ওনার চোখদুটো হেঁসে ওঠে। আমি চোখ সরালাম না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। উনি উঠে বসার চেষ্টা করলেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে ধরতে গেলাম। উনি হাত বাড়িয়ে বারণ করতে চাইলেও আমি ধরে বসিয়ে দিলাম। মাসিমা নেই, একপ্রকার আমার কাজই করতে গেছেন, তাই আমার একটা নৈতিক দায়িত্ব থেকে যায়। বসতে বসতে মৃদুস্বরে ধন্যবাদ জানালেন। পাশ থেকে বালিশটা নিয়ে পিঠের দিকে নিলেন। সত্যি কথা বলতে কি মাসিমার সাথে আমার বহু কথা হয়, মেসোমশাইয়ের সাথে মুখোমুখি কথা প্রায় হয়নি বললেই চলে। উনি অসুস্থ থাকায় সারাক্ষণ প্রায় শুয়েই থাকেন। মাসিমার সাথেও সেভাবে কথা বলতে দেখিনি, বেশিরভাগ সময় ইশারা-ইঙ্গিতেই নিজের প্রয়োজনটুকু বুঝিয়ে দেন। আজকে উনি প্রথম আমাকে সম্বোধন করে কথা বললেন, "আপনি কে জানিনা! এই ট্রেনে সওয়ারী হয়েছেন কেন তাও জানিনা, তবে আপনি খুব ভালো কাজ করছেন। এই গরীব-গুর্বো, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের তো পায়ে মাড়িয়ে চলে যাওয়াই রীতি, কিন্তু আপনি তার বিপরীতে হাঁটছেন।" আমি তো অবাক, ভদ্রলোককে এতগুলো কথা একসাথে বলতে কখনও শুনিনি। তাছাড়া উনি যে আশপাশের ব্যাপার নিয়ে আদৌ লক্ষ্য রাখেন, সেগুলো নিয়ে ভাবেন, সেটাও কখনও মনে হয়নি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার চোখদুটি হেঁসে উঠল। মুখে বললেন, "আমি অসুস্থ মানুষ কিন্তু আমার চোখ-কান খুব সজাগ। তুমি আমাদের জন্যেও যা করছ, আমাদের নিজেদের সন্তান থাকলেও এতটা করতো না"। এবার আমি লজ্জা পাই। বলে উঠি, "এ কী বলছেন! দেখুন আমিও আপনাদের মত অনির্দেশের সওয়ারি। অলস হয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না, সেখান থেকেই কিছুটা সময়..." আমাকে প্রায় বাধা দিয়েই উনি বলে উঠলেন, "না না শুধু সময় দিয়ে সবকিছু হয়না, মন চাই। মন সায় না দিলে তুমি কিছুই করতে পারবেনা। মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু করার ইচ্ছে রাতারাতি মনে বাসা বাঁধতে পারেনা"। এই বলে ভদ্রলোক কাশতে শুরু করলেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। জানি, ওনার কাশি একবার শুরু হলে, ভীষণরকম কষ্ট পান। ওনাকে কথা বলতে বারণ করে তড়িঘড়ি একগ্লাস জল এগিয়ে দি। কপালজোরে জল খেয়ে ওনার কাশি ধীরে ধীরে কমে এল। আমি ওনাকে ধরে শুইয়ে দিলাম। খেয়াল করলাম উনি হাত দিয়ে আমার কব্জিটা ধরে আছেন। শোয়ার পরও ছাড়েননি, ইশারা করলেন পাশে বসতে। ওই অবস্থায় চোখ বুঝলেন। আমি চুপচাপ বসে আবার আকাশের দিকে চাইলাম। সাদা মেঘের ভেলা এখন কম, ঘন নীল মেঘের চাদরে ইতস্তত কালো কালো ছোপ। তবে ভয়ের কিছু নেই, এ মেঘ আশ্বিনে মেঘ নয়, এ মেঘে ঝড়জলের সম্ভাবনা লুকিয়ে নেই। এমনসময় হাতে টান পড়ল, ঘুরে তাকানোর আগেই কানে এল শ্লেষ্মাজর্জর ক্লান্ত কণ্ঠ, "একটা গল্প শুনবে?"

                                               

 (ক্রমশঃ………)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ