সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভালোবাসার গল্প - মিথ্যুক



লেখা- আশিক মাহমুদ রিয়াদ 

সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো। জানলা দিয়ে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে মুখে। ঠোট ফেঁটে গেছে। অসহ্য জ্বালা। ঘুম থেকে উঠেই হাতরে হাতরে সিগারেট খুজতে লাগলাম৷ প্যাকেটে একটি মাত্র সিগারেট অবশিষ্ট ছিলো। ফাটা ফাটা ঠোটদ্বয়ের মাঝখানে সিগারেট রেখে লাইটারের আগুন ধরলাম সিগারেটের মাথায়। গত দু সপ্তাহ বাইরে যাই না,বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।

দরজায় নক করছে কেউ। ঠোট ফেটে রক্ত বেরিয়েছে,সিগারেট ভিজে গেছে রক্ত৷ ভিজুক! শুধু ধোয়াটা বুকে গেলেই হলো। মাথায় গেলেই হলো, সব থেকে ভালো হয় মরে দেতে পারলে। আত্মহত্যাও করলে খুশি হতে পারতাম। তবে নিজেকে মারতে চাই তিলেতিলে। যেমন মেরে ছিলাম ওদের দুজনকে। এইসব দূঃসহ স্মৃতি মনে করতে চাই না। মনে করতে চাই না দেখেই সিগারেট খাই! মাঝেমধ্যে আরো বড় কিছু। আমি আমাকে মারতে চাই তিলে তিলে, একটু একটু করে।

দরজা খুলতেই কয়েকজন মানুষের দেখা পেলাম। এরা আমার প্রতিবেশি, বড্ড উত্তাক্ত করে। আমি তাদের মোটেও উত্তাক্ত করি না, শুধু তারা এসেই আমাকে উত্তাক্ত করে,বিরক্তি করি। 
সিগারেট ঠোটে রেখেই বললাম,'কি চাই?' একজন বৃদ্ধ মহিলা শঙ্কিত গলায় বলল,'তিন দিন ধরে খাওনি তুমি কিছু, এই খাবার গুলো খেয়ে নাও। এভাবে না খেলে মারা যাবে। ' আমি সিগারেট ঠোট থেকে নামিয়ে বললাম,'একজন মানুষ না খেয়ে দু সপ্তাহ বাঁচতে পারে। '  এই বলে তাদের মুখের উপর ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। কল্পনায় তাদের মন খারাপ আর রাগন্বিত চেহারা ভেসে উঠলো। 
উঠুক,আমি মানুষকে কষ্ট দিয়েই মরতে চাই। যেমন কষ্ট দিয়ে মেরে ছিলাম ওদের দুজনকে। 

২.
সেদিন ছিলো নওশার জন্ম দিন। আমি অফিসে যাওয়ার আগে ওকে কথা দিয়েছিলাম আমি ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের এক ঘন্টা আগেই ফিরবো। 
ফিরতে হলো এক ঘন্টা পরে, এলিজা ভুরু কুচকে বসে আছে, তার মুখে রাগের আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। নওশা তার মায়ের পাশে বসে আছে৷ 

আমি ওদের কাছে গিয়ে মৃদু সুরে বললাম,'সরি! একটু লেইট হয়ে গেলো। ' নওশা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এলিজা নওশাকে বলল,'চলো মা! এখানে বসে থাকতে হবে না। রুমে চলো। নওশা তার মায়ের সাথে চলে গেলো বুঝলাম এদের রাগ এত সহজে ভাঙানো যাবে না। 

কিছুক্ষণ পর জোকার সেজে হাজির হলাম। নওশাকে জোক্স বললাম। এত হাসির জোক্স বললাম যে জীবনেও হাসে নাই সেও হেসে ফেলবে। নওশা হাসলো না। কম্বোলের নিচে মুখ লুকালো। 
এরপর ভাবলাম রান্না করব কিছু একটা, নওশা পাস্তা খেতে ভালোবাসে। পাস্তা বানালাম, রুমে গিয়ে নক করলাম। নওশা এবং নওশার মা কেউ পাস্তা খেতে আগ্রহী না, মুখে ভেংচি কেটে বুঝিয়ে দিলো। 
এবার আমার দারুন মন খারাপ হলো,ড্রয়িং রুমে বসে রইলা একা একা। কিছুক্ষণ বাদে নওশা এলো হাতে প্লাকার্ড নিয়ে। প্লাকার্ডে লেখা,'বাবা তুমি মিথ্যূক। তার নিচে ছোট করে লেখা, 'তারপরেও তুমি আমার বাবা। ' আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম। এলিজা এসে ভাগ জমালো আমাদের বাবা মেয়ের আদর খুনসুটিতে। 

৩.
কতদিন আয়না দেখি না তার ঠিক নিয়ে। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দারুন কূৎসিত দেখালো। চোখের নিফে কালো দাগ আর ফাঁটা ঠোট। কপালের কোনে অনেক বড় একটা দাগের চিহ্ন। এই দাগই আমাকে পাপিষ্ট করে তুলেছে, যতবার এই দাগ দেখি ততবার ই নিজেকে মনে হয় আমি একটা খুনি। আমি ওদের দুজনকে মেরেছি। আমি মিথ্যূক,আমি পাপি। এক ঘুষিতে আয়নাটা ভেঙে ফেললাম। হাত কেটে গেলো,ব্যথায় কাঁকিয়ে উঠতে উঠতেও উঠলাম না। 
আজকাল আর নিঃসঙ্গ লাগে না। একা একা কাঁদতেও ইচ্ছা করে না । মাঝেমধ্যে অনেক কান্না পায়। ফু্ঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি যে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছি সেটা আর বোঝার বাকি নেই,নিজেও জানি,আমি একটা উন্মাদ তার থেকে বড় কথা আমি পাপী, আমি খুনি। মাঝেমধ্যে এই কথা গুলো আমার চারপাশে ঘোরে। আমার প্রতিচ্ছবি আমাকে এসব বলে ক্ষিপ্ত করে তোলে। চারদিকে থেকে একটা আওয়াজ ই আসে। আমি খুনি,আমি খুনি,আমি খুনি।  

৪.
 নওশাকে পাস্তা বানিয়ে দিয়েছিলাম বলে সে আমার পছন্দের চিকেন ফ্রাই আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বানাতে গিয়েছিলো।ছয় বছরের নওশার মাথায় কী বুদ্ধি! কী পাকা পাকা কথা!  মাঝেমধ্যে আমাকে আর ওর মাকে বেশ শাসনে রাখে নওশা। ও যে এই পরিবারের একমাত্র শাসন কর্তা। নওশা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিকেন ফ্রাই বানাতে গেলো। এ ব্যপারে অবশ্য সাহায্য করবে এলিজা। পুরো কাজটাই করবে এলিজা, নওশা থাকবে উপদেষ্টার ভূমিকায়। 

আমি ব্যালকনিতে হেডফোন গুজে আনমনা হয়ে গান শুনছিলাম। আর নিজেকে তখন ভাগ্যবান মনে হলো। ছোটবেলায় বাবা মায়ের আদর বেশিদিন পাইনি। তারা আমাকে ছেড়ে অনেক আগেই পরলোকে পারি জমিয়েছেন। গোটা জীবনের পরিশ্রম শেষে একটা সুখি সংসার পেয়েছি,আর কি চাই আমার? 
অনেকক্ষণ হয়ে গেলো,নওশা আর ওর মায়ের খোজ নেই। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে বেশ। আমি পা বাড়ালাম কিচেনের দিকে। আমার হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেলো। এক দৌড় দিলাম,নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে। দাউ দাউ করে আগুনে পুড়ছে আমার দুই কলিজা। 

পাস্তা বানানোর সময় তাড়াহুড়ো , গ্যাসের চুলাটা ভালোভাবে বন্ধ করতে পারেনি রাফৈদ। এদিকে ভেন্টিলেটারের ফ্যানটা তার আগের দিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। গ্যাসে পরিপূর্ন হয়ে গিয়েছিলো কিচেন৷ গ্যাসের চুলা জ্বালানোর সাথে আগুন লেগে যায়, দুজনের শরীরে। দুজন চিৎকার করলেও হেডফোন কানে থাকায় শোনেনি কিছুই। 

রাত বারোটা! হঠাৎ চিৎকার শোনা যায়। তারা দুজন একে অপরের মুখের দিকে তাকায়৷ প্রথম যেদিন এরকম হয়েছিলো সেদিন ছুটে গিয়েছিলো সবাই৷ এর পর এই স্ট্রিটের প্রত্যাহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চিৎকার একজন বাবার। কিছুক্ষণ পর আবার চিৎকার থেমে যায়,চাঁদ ঢলে পড়ে আকাশে। ঘুমিয়ে পড়ে সবাই,শুধু ঘুমায় না সে! 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ