সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

বিজ্ঞান যেটা কে ভুল বা মেকি বলছে , সেটাই ভুল বা মেকি বলে মানতে হবে কেন ?

মিরাজুল হক  

ভাইরাস টির বয়স মাত্র দেড় বছর হবে । এই ভাইরাসের সংক্রামণে বিশ্ব জুড়ে  বিপর্যয়, তছনছ হচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিবেশও । একই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন , হরেকরকম উত্তর । আজ যেটা ঠিক বলা হয়েছিল , আগামীকাল সেই নির্দেশিকা বাতিল করা হল ।  ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ! চট-জলদি পরীক্ষা নিরীক্ষার দাবী । দ্রুত সুরাহ ও সমাধান দরকার ক্ষিপ্র গতিতে । রিসার্চ – সায়েন্টিস্টদের উপর প্রবল চাপ , উত্তেজনা । এবং রাষ্ট্র নেতাদের হুকুম নির্দেশ । সবমিলিয়ে বিশ্ব জুড়ে বড় গণ্ডগোল। 


একই সংগে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের  ( Conspiracy Theory ) জোরালো প্রচার। পুঁজিবাদী মুনাফা ও বিশ্ব ব্যাপী একটি নিয়মের শাসন ( One World Theory ) । মানুষ যখন দুঃসময়ে , যাপিত জীবনের অনিশ্চয়তায়  , প্রিয়জনকে হারানোর সীমাহীন কষ্টে   , তখনই  এই ধরনের  ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচারের আদর্শ সময় । তা মানুষকে প্রভাবিত করে দ্রুত । ছোঁয়াচে রোগের মত ছড়িয়ে পরে । 

 

আর তখনই প্রশ্ন -  বিজ্ঞানীরা করে টা কি ? বিজ্ঞান যেটাকে   ‘Exact Knowledge ‘বলছে  তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন । বিজ্ঞান যেটাকে জ্ঞান বলছে , সেটা কি সত্যিই জ্ঞান … না কি তা বিভ্রম । শুরু হয়ে যায় যুক্তি তর্কের লড়াই -   ‘Exact Knowledge ‘ বনাম আত্মবিশ্বাস । বৈজ্ঞানিক ধারনা বনাম অবৈজ্ঞানিক বিবৃতি । Testability vs Falsifiability । তাই কি ভাবে আমরা গ্রহণ করবো বিজ্ঞান কে , যা যথাযথই    ‘Exact Knowledge ‘ ।  

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা নিরিক্ষার সাহায্যে যুক্তিসম্মত পদ্ধতিতে প্রকৃতির নিয়মাবলী খুঁজে একটা অপেক্ষাকৃত ভালো সমাধান বের করেন । হাজারো প্রশ্ন করে , অজ্রস সন্দেহ তুলে তবে তাঁরা একটা কোন সিদ্ধান্তে আসেন । তারপরেও সে সিদ্ধান্ত কতদিন ঠিকবে , তা কেউ বলতে পারে না । 

ইউরোপে রেনেসাঁ যুগের পর থেকেই পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে সিদ্ধান্তে পোঁছানোর পথটিকে বিজ্ঞান নিজের পথ বলে বেছে নিল । সচেতনভাবে চিনে নিল । কোপার্নিকাস , কেপলার , গ্যালিলিও হয়ে নিউটনে পৌঁছে বিজ্ঞান তার বিজয়কেতন উড়িয়ে দিল । পরবর্তীকালে বিজ্ঞান নির্ভর প্রযুক্তির অকল্পনীয় ব্যবহারিক সাফল্য এই স্বীকৃতি কে উত্তরোত্তর জোরালো করে তুলেছে । একই সংগে মনের বিশ্বাস , আত্মবিশ্বাস বা ধর্ম বিশ্বাস কে সত্যের একচেটিয়া আধার বলে একেবারেই মানতে চাইল না । দর্শনের সংগে দূরত্ব প্রকট হল । স্টিফেন হকিং তো কোন রকম রাখঢাক না করেই অভিযোগ করেছেন যে , ‘ দার্শনিকরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সংগে তাল রাখতে পারছেন না ।‘ 


অন্যদিকে দর্শন বিষয়ে বিজ্ঞানীরাই বা কতটা ওয়াকিবহাল ?  বিজ্ঞানের তত্ত্ব গঠনের পেছনে দার্শনিক মতের যে একটা বিরাট ভুমিকা রয়েছে , সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই । এছাড়াও বিজ্ঞানের দর্শনের একটা ব্যবহারিক দিক আছে । আজ থেকে বছর পঞ্চাশ ষাট   আগে সৎ ও মানবপ্রেমিক বিজ্ঞানীরা পরিবেশ , ইকসিস্টেম , বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের কুফল সম্বন্ধে খুব একটা সচেতন ছিলেন না । যুদ্ধের জন্য বিজ্ঞান নয় – এইটুকুই ছিল তাদের প্রার্থনা । 


আজ আমরা জানি , এ আশা দুরাশা । বিজ্ঞান নিজেই নানান ক্ষতির কারন হয়ে উঠছে । বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা কতটুকু ! সরকারী ও ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ কতদূর ? কি নিয়ে তাঁরা গবেষণা করবেন বা করবেন না … , এইসব প্রশ্নের উত্তর উঠে পড়ে বিজ্ঞানের দর্শন প্রসঙ্গ , দৃষ্টিভঙ্গির , বস্তুনিরপেক্ষতা ( Objectivity ) ও বক্তাসাপেক্ষতার ( Subjectivity ) প্রসঙ্গ । তাই বিজ্ঞানের এই দিকটা শুধু হাওয়ামহলের ব্যাপার নয় । একদম কঠিন মাটির প্রশ্ন , বাস্তবিক কঠিন বিষয় । তাই বিংশ শতকে বিজ্ঞানের দর্শন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে । তার প্রধান আলোচ্য দিক দুটি – জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology ) এবং পদ্ধতিতন্ত্র ( Methodology)।  


বিশ শতকে এই ‘ বিজ্ঞানদর্শন ‘ নিয়ে বিশেষ আলোচনা শুরু হয় । এই বিষয়ে  বিজ্ঞানী কার্ল রেমন্ড পপার ( Karl Raimund Popper , 1902-94) ও আরো অনেকের   ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । প্রাতিষ্ঠানিক মৌলবাদ , জ্যোতিষ , অলৌকিকতা , বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে অবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার জেদ – এইসব কাজ প্রচণ্ড ভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে । এই স্রোতকে ঠেকানোর কাজ খুব জরুরী । এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানদর্শন খুব তাৎপর্যময় । 


বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো কিভাবে ঘটে ?  একজন বিজ্ঞানী যখন কোনকিছু পর্যবেক্ষণ করেন , পরীক্ষা চালান তখন তাঁর মনে আগে থেকেই কতকগুলো প্রত্যাশা থাকে । এক বা একাধিক তত্ত্বপ্রস্তাব ( Hypothesis ) তাঁর মনে তৈরি হয় । তারই ভিত্তিতে তিনি ঠিক করেন , কোন পরীক্ষাটি চালাবেন বা কি পর্যবেক্ষণ করবেন । এই বক্তব্য পপার-তত্ত্বের প্রধান স্তম্ভ । বিজ্ঞানী পিটার মেডওয়ার এই বক্তব্যটি কে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছেন । 


1919 সালের মে মাসে , বিংশ শতাব্দীর – হয়তো মানুষের ইতিহাসেরই মহত্তম একটি ঘটনা ঘটলো । মাত্র কয়েক বছর আগে গানিতিক গবেষণার সুত্রে আইনস্টাইন , তাঁর সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রণয়ন করেছেন । সেই তত্ত্ব নিউটনের অভিকর্ষ বিষয়ে নতুন ধারনার প্রবর্তন করে । 1919  সালের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় , তা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমানিত হয় । দেখা গেল অভিকর্ষের টানে আলোকরশ্মিও বেঁকে যায় – আইন্সটাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী যতটুকু বাঁকাবার কথা , ঠিক ততটুকুই বাঁকে । এই বেঁকে যাওয়া টা নিউটনের অভিকর্ষ – তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না । অর্থাৎ দুশো বছর রাজত্ব করার পর নিউটনীয় তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা সুনির্দিষ্টভাবে প্রমানিত হল । আইনস্টাইন নিশ্চিতভাবে নিউটনের চেয়ে উন্নত এক তত্ত্বের সন্ধান দিলেন । তবে নিউটনের এই সিংহাসনচ্যুতি   কিন্তু বিজ্ঞানের পরাজয় সূচিত করল না । বিজ্ঞানের আশ্চর্য গতিময়তা কে মূর্ত করে তুলল । 


সুতারং বিজ্ঞানই মানুষের সেই জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র , যেখানে মানুষ নিজের ভুল নিজে স্বীকার করতে প্রস্তুত । এই নিজের ভুল স্বীকার করার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান এগিয়ে চলে । প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বাড়ে । এখানে ভুল মানে পরাজয় নয় , পতন নয় । এখানে ভুলই আগামী অগ্রগতির দিক নির্দেশ । তাই বিজ্ঞান কখনো শাশ্বত নয় , পূর্ণ নয় । 1929 সালে প্রকাশিত হয় ইশতেহার – বৈজ্ঞানিক বিশ্বধারনা ঃ ভিয়েনা সার্কেল । এই ইশতেহারে বিজ্ঞানের সামাজিক , রাজনৈতিক ও দার্শনিক অবস্থানটি স্পষ্ট হয় ।   


যাচাইকরণের ( Verification ) বদলে পরীক্ষাসিদ্ধাতাকে ( Testability ) আমরা বিজ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য বলে চিনে নিতে পারবো । বিজ্ঞানী পপারের মতে একটি বৈজ্ঞানিক বিবৃতির সংগে একটি অবৈজ্ঞানিক বিবৃতির তফাৎ কোথায় , তার একটা সরল উদাহারন দেওয়া যেতে পারে । দুটো ব্যাক – 

               ১। কাল বৃষ্টি হতেও পারে , না-ও পারে ।

               ২। কাল বৃষ্টি হবে । 

বিজ্ঞানী পপারের মতে , প্রথম বাকটি খণ্ডন করা যায় না , বাস্তব পরীক্ষার সাহায্যে তার সত্যতা বা অসত্যতা – কিছুই ঠিক করা যায় না । তাই ওটি একটি অবৈজ্ঞানিক বিবৃতি । অন্যদিকে দ্বিতীয় ব্যাকটি র সত্যাসত্য নির্ণয় করা যাবে । কাল বৃষ্টি হল কিনা তা পর্যবেক্ষণ করে বলা যাবে । বিবৃতিটি হয় সত্য , না হয় মিথ্যা । বিবৃতিটি খণ্ডনযোগ্য বলেই তা বিজ্ঞানসম্মত ।  তাই এটা বৈজ্ঞানিক বিবৃতি । 


নিউটনের অভিকর্ষ তত্ত্ব বড় উদাহারন । 1687 থেকে 1900 সালের মধ্যে অসংখ্যবার যাচাই করা হয়েছিল । কিন্তু 1900 থেকে 1920 সালের মধ্যে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেল , যা নিউটনের তত্ত্বের সার্বজনীন সত্যতা কে অ-প্রমান না খণ্ডন করল । আমারা পেলাম আইনস্টাইনের নতুন তত্ত্ব । প্রকৃতির অনেক বেশি ঘটনাকে তা ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হল । আমাদে জ্ঞান বাড়ল । নিউটনের তত্ত্ব প্রকৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলেই তাকে খণ্ডন করা গেল । অধিবিদ্যা বা বিশ্বাস বা জ্যোতিষশাস্ত্রে এই ভাবে খণ্ডনযোগ্যতার মাপকাঠি অচল । তাই তা বিজ্ঞান নয় । 

পপারের এই খণ্ডনযোগ্যতার সত্যমিথ্যা , বিজ্ঞানের কয়েকটা আবিস্কার পর্যালোচনা করলে সহজ প্রমান মিলবে । 

1932 সালে ডোম্যাক  ( Domagk , 1895-1964 ) পৃথিবীর প্রথম রসায়নিক  অ্যান্টি বায়োটিক সালফোনামাইড আবিস্কার করেন । যা সালফা ড্রাগ নামে পরিচিত । পেপারটি প্রকাশিত হয় 1935 সালে । স্ট্রেপটোক্কাস জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত ইঁদুরের রোগ সারানোর ব্যাপারে এই সালফা রসায়নিকটি বিশেষ কার্যকর । এই কেমিক্যাল যৌগটির আগে , আর অনেক যৌগ ব্যবহার করা হয় । কিন্তু তা কার্যকর হয় নি । বৈজ্ঞানিক ঘটনা সরল নয় , জটিল । এবং সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ একই সংগে চলে ।  সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ – এই দুটি পদ্ধতি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় । একে অপরের পরিপুরক । পৃথিবীতে এমন কোন তথ্য নেই , যা সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য ? 

আজকের এই উত্তর–আধুনিকতার যুগে খোলা মনে মাথা ঘামানোটা বিশেষভাবে জরুরী হয়ে পড়ছে । কারন আমরা আদৌ কোন কিছুকে জানতে পারি কিনা তা নিয়ে  হাস্যকর সব প্রশ্ন উঠছে । সে সব প্রশ্ন কোন কোন মহলে বেশ ফ্যাশনেবলও হয়েছে ।          


তথ্য নির্দেশিকা ;

1.কার্ল পপার , Unended Quest .

2. বিজ্ঞানের দর্শন ও কার্ল পপার – আশীষ লাহিড়ী 

3.  ইতিহাসে বিজ্ঞান  – জে ডি বারনাল ( অনুবাদ আশীষ লাহিড়ী ) 


[প্রকাশিত লেখাটির দায়ভার সম্পূর্ণ লেখকের ]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ