সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ওলো সই - অদিতি ঘোষ দস্তিদার

   


 

অদিতি ঘোষদস্তিদার 


আদরের সই বিদীপ্তা,

আজ বিকেলে গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি কি করে টুক করে একে ওকে গলিয়ে রাস্তা পেরোন যায়, ঠিক তখনই হঠাৎ একটা গাড়ির খোলা জানলায় যেন একঝলক দেখলাম তোর মুখ! উথলে উঠলো বুকের ভেতরটা! বিদীপ্তা না? ঠিক না ভুল, তুই না কি অন্য কেউ এই ভাবনার পেন্ডুলাম একটা গোটা  চলন শেষ করতে না করতেই দেখি সিগন্যালে আটকানো গাড়িটা হাওয়া! 

আরে! গেলো কোথায়? 

সেই গাড়ি ততক্ষণ  টাটকা খোলা সবুজে পাড়ি দিয়েছে অনেকটাই। মনটা যে কী ভীষণ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল! নিজের ওপর রাগটা ফলালাম এক বেচারা মাটির ভাঁড়ের ওপর।  বাড়ি ফেরা অবধি আমি যে কোথায় আছি, কি ভাবছি তা মাঝে মাঝেই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। নেহাত অটোটা যাদবপুর অবধি তাই বাঁচোয়া ছিল। লাস্ট স্টপে নেমে রিক্সায় করে বাড়ি। 

ও হো! ভাবছিস যাদবপুর কেন? আরে ওখানেই তো আমার শ্বশুরবাড়ি এখন! তুই তো আমার বিয়ের আগেই তো বরের সঙ্গে বিদেশ পাড়ি! আর আমিও তারপর কর্তার ইচ্ছেয় কলকাতা ছেড়ে মুম্বাই! ওখানেই থাকি। এসেছি কিছুদিন কলকাতায়। 

সে কোন যুগের কথা তাই না?  দেখতে দেখতে আমার বড় মেয়েই বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠলো! তখন তো আর এখনকার মতো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না! তাহলে কি আর তোকে হারিয়ে ফেলি? 

কীভাবে কেটে গেলো না এতোগুলো দিন! একদিন ইস্কুলে দেখা না হলে গলার কাছে ডেলা  পাকাতো।

 পাপড়ি কেমন ভাবে বলতো, ‘আজ একটু তোর পাশে বসি না রে! আজ তো বি আসেনি’, আমি বলতাম,  ‘কেউ না কেউ তো বসবে আজ  তুই-ই বোস, কিন্তু বি এলে আর না কেমন?’ পাপড়ি হেসে বলতো, ‘জানি, তাহলে তো বি হুল ফুটিয়ে দেবে’-  মনে হচ্ছে সেদিনের কথা! হাসি, রাগ, অভিমান, ছেলেমানুষিভরা দিনগুলো! 

কেমন আছিস বি? থাকিস কোথায়? চিঠিটা তো পাঠাতে হবে কোনো ঠিকানায়! বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে তোর খোঁজ করেছিলাম, ফেসবুকেও খুঁজে ছিলাম! কিন্তু লক্ষ বিদীপ্তার মধ্যে কোনটি আমার সই তা তো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজারই সামিল - তাই না?  বিদেশ যাবার পর গোটা দুই চিঠি তুই দিয়েছিলি, ব্যাস তারপর চুপচাপ।  আমার বিয়ের নেমন্তন্ন করতে তোদের সেই যে বাড়ি যার ঠিকানা ছিল পিয়ারাতলা, সেখানে গিয়ে শুনলাম তোর বাবা মা আর ওখানে থাকেন না ! বাড়িটা যে ভাড়াবাড়ি ছিল সেটা আমার জানা ছিল না। তোর বিদেশের ঠিকানায় কার্ড পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু উত্তর আসেনি কোন। পুরো যোগাযোগটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল। 

 তারপর আস্তে আস্তে  চাকরি আর নতুন সংসারের চাপে কখন চাপা পড়ে গেলো কৈশোর আর কিশোরীবেলার সঙ্গীরা।

আচ্ছা, জানি না তোর বিষয়ে কিছুই, তাহলে বাড়ি ঢুকেই হঠাৎ হড়বড় করে চিঠি লিখতে বসলাম কেন বলতো? আসলে পুরোনো অভ্যেস তো সেই ছোটবেলা থেকে, তাই! তুই তো জানতিস! কিছু ঘটলো তো ফরফর করে চিঠি লেখা! সমীরণকেও কত্ত দিতাম! রোজ দেখা হচ্ছে তাও গুচ্ছ গুচ্ছ  চিঠি।  

আমার এই চিঠি লেখার অভ্যেসই স্কুলজীবনে নিয়ে এসেছিলো মহা বিপদ, মনে আছে তোর?

ক্লাস টেন।  কী কারণে যেন ঝগড়া হয়েছিল আমাদের, আজ আর মনে নেই। ও তো লেগেই থাকতো।  

সে ভারী মজার দিন ছিল আমাদের। দুই বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া হলে বাকি বন্ধুরা যেই না জানতে পারলো, ধরে নিয়ে যেত ভাব করাতে।  তারপর সেই ভাব হয়ে যাওয়া বন্ধুরা খাওয়াতো বাকিদের,  যারা ভাব করালো।  ক্লাস টেনে উঠে হঠাৎ নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হচ্ছিল।  তাই দু’একজন ভাব করিয়ে দিতে আগ্রহী হলেও সে ধার মাড়াইনি। কিন্তু মন তো 

খচ খচ করছে।  তাই অনেক ভেবে লিখে ফেললাম একখানা চিঠি। কিন্তু দেব কী করে? বন্ধুদের কাউকে দিয়ে পাঠালে সে নির্ঘাত পড়বে আর সারা জীবন খ্যাপাবে। 

সুযোগ এসে গেলো পিটি ক্লাসে।  ঠিক টিফিনের আগের পিরিয়ডে পিটি।  আমাদের সেই মফস্বলের ইস্কুলে তখন কী সুন্দর মাঠটা ছিল বল? তুই বোধহয় জানিস না, সে মাঠ আর নেই। বিল্ডিং উঠেছে। 

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। পিটি ক্লাসের ঠিক পরেই টিফিন। ঘন্টা পড়তেই সব মেয়েরা হুড়মুড়িয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মাঠে অন্য সব ক্লাসের মেয়েরাও আসতে শুরু করল । আর আমিও সেই হইচইএর মধ্যে সুযোগ বুঝে তোর হাতে দিলাম গুঁজে চিঠি।

দুটো ঘন্টা পড়তো টিফিনের পর ক্লাসে যাবার।  প্রথমটা ওয়ার্নিং।  মাঠটা বেশ ফাঁকাই হয়ে গেলো প্রথম ঘন্টার পর। দেখি তুই গুটিগুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছিস। মুখে সেই অনাবিল হাসি।  এই লিখতে লিখতেও সেই হাসি আমার চোখে ভাসছে যেন।  আমি দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে তোকে জড়িয়ে  ধরলাম।  চিঠিটা তুই আগেই একবার পড়েছিলি। আবার  গলা জড়াজড়ি করে পড়লাম দুজনে। তারপর হাসতে হাসতে চিঠিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে ক্লাসে ফিরে গেলাম। 

টিফিনের দ্বিতীয় ঘন্টা পড়ার আগেই পৌঁছে গেছি ক্লাসে। বেঞ্চে বসতে যাচ্ছি হঠাৎ টিচার্স রুম  থেকে আমাদের দুজনকে ডেকে পাঠানো হলো। অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে গুটি গুটি পায়ে ভয়ে ভয়ে গিয়ে হাজির হলাম দুজনে টিচার্স রুমে। বুঝেই উঠতে পারছি না কী করেছি ! 

টিচার্সরুমে ঢুকে দেখি বড়দিদিমণিও সেখানে উপস্থিত। তার মানে নিশ্চই বড়োসড়ো কিছু একটা করেছি আমরা! কিন্তু কী সেটা? শত চিন্তা করেও বের করতে পারছি না!

বন্দনাদি মুখ খুললেন, ‘তোমরা মাঠে কোন চিঠি পড়ছিলে? কে পাঠালো সেই চিঠি আর দিলোই বা কাকে? তোমরা ছিঁড়লেই বা কেন? ভয়ে? লুকোবার জন্যে?’ 

মুহূর্তের মধ্যে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো! টিচার্স রুমটা দোতলায় আর তার জানলা দিয়ে মাঠটা পরিষ্কার দেখা যায়।  পর্দা তুলে দিদিমনিরা অনেক সময় দেখেন সেটা জানা ছিল।  

তার মানে কেউ দেখেছেন আমাদের চিঠি পড়া আর ছিঁড়ে ওড়ানো!

চিন্তার ঘুড়ি একটানে মাটিতে নেমে এলো গৌরীদির হুঙ্কারে !

‘ক্লাস টেন তোমরা! সামনের সারির মেয়ে সব! তোমাদের ওপর স্কুলের কত আশা! আর তোমরা এই সব করছ!’

আমতা আমতা করে তুই তখন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলিস এমন সময় সমরদা ঢুকলেন, আমাদের স্কুলে অফিসরুমের স্টাফ ছিলেন। হাতে কুচি কুচি কাগজের টুকরো। বুঝলুম এই সেই টুকরোগুলো যা আমরা উড়িয়েছিলাম। 

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম দুজনে মনে হচ্ছিলো যেন অনন্ত কাল! কী যে ভাবছিলাম আবোল তাবোল আজ আর মনে পড়ে না! কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে আমরা চমকে উঠেছিলাম মুক্তিদির হাসিতে! তাঁর হাসি আর থামছিলোই না ! 

বড়দি ধমক দিয়ে বললেন, ‘চিঠিটা জুড়েছ মুক্তি?’ 

বেশ স্পষ্ট মনে আছে , মুক্তিদি তাড়াতাড়ি হাসি থামিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ বড়দি! যতটা পেরেছি জুড়েছি আর পড়েওছি।  দোষটা আমাদেরই বড়দি! আমরা আশংকা করেছিলাম অন্য কিছু। কিন্তু এ দুটো এখনও ছোটোই আছে! দেখুন কেমন লিখেছে!’, বলে সেই চিঠির কিছু কিছু অংশ পড়তে শুরু করলেন আর গোটা টিচার্স রুমটা হাসিতে ফেটে পড়লো!

আচ্ছা এই চিঠিও কি কুচি কুচি করে উড়িয়ে দেব? দিলেই কি সেই দিনগুলো ফিরে পাবো বি? একটা টুকরো যদি হাওয়ায় ভাসতে  ভাসতে তোর কাছে যায়! আমি জানি তুই ঠিক চিনতে পারবি এ আমার লেখা, তাই না ?

না রে, বয়েস হয়েছে তো, তাই লজিকাল বুদ্ধি আমার রূপকথা-মনটাকে অনেকদিন হারিয়ে দিয়েছে সংসার যুদ্ধে! এ চিঠি আমার টাইম লাইনে পোস্ট করলাম পাবলিক অপশনে! দেখি টেলিপ্যাথির জোর আছে কিনা!

-অদিতি 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ