সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

বাবা দিবসের গল্প


এইসব দিন রাত্রি

জোবায়ের রাজু  


নিত্যদিনের অভাব আর টানা পেঁাড়নের সংসারে আমরা যে না খেয়ে কেমন করে বেঁচে আছি, এটাই একটা দুর্লভ রহস্য। আমাদের স্কুল টিচার বাবার কঁাধে সংসারের বিশাল দায়িত্ব। স্কুল থেকে মাসিক যে বেতন পান, তা দিয়ে কোনো রকম আমাদের ডাল ভাতে দিন কাটে। বড়দার আয়েসি জীবনধারা দেখে বাবার গা জ্বলে যায়। অভাবের এই সংসারে বড়দার চলা ফেরা দেখলে মনে হবে সে যেনো কোনো মহা রাজার পুত্র। তার পোষাকের চাকচিক্য ভাব, আধুনিক লাইফ স্টাইল দেখে বাবা প্রায়ই মাকে বলেন ‘দিদার এতো পয়সা পায় কোথায়?’ 



দিন দিন আমরা জানতে পারি আমাদের পরিবারের সব চেয়ে নম্র ভদ্র ছেলে বড়দা একজন সাধু চোর। সুÑকৌশলে অন্যের জিনিস চুরি করতে তার দক্ষতা বেশ। বাবা অপমানে আর লজ্জায় মুখ লুকান। বড় ছেলে যে তার শিক্ষকতা জীবনে কি কলঙ্কই না ডেকে এনেছে। একদিন মাঝ রাতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাবা বড়দাকে পিটিয়ে প্রতিবাদী গলায় বলেন ‘বের হও আমার বাড়ি থেকে। এই বাড়িতে চোরের কোনো থাকা নেই।’ রাতেই বড়দা ঘর ছাড়ে। ভোর পর্যন্ত মা নিরবে কঁাদলেন। 


সংসারের মায়া বড় অদ্ভুত জিনিস। সে কারণে বড়দা বেশি দিন আর বাইরে থাকতে পারেনি। এক সুনসান সন্ধ্যায় বড়দা বাড়ি এসে বাবার পা জড়িয়ে ধরে রুগ্ন গলায় কঁাদতে কঁাদতে বলল ‘আমাকে মাফ করেন আব্বা।’


আর চুরি করবে না বড় ছেলে, এমন প্রতিশ্রুতি পেয়ে বাবা বড়দাকে মাফ করে দিলেন। কিন্তু চুরির অভ্যাস থেকে নিস্তার পায়নি বড়দা। আবারো চুরি কর্মের মহা নায়ক হয়ে উঠলো। তার চুরির ঘটনা চারদিক থেকে জানাজানি হয়। সবাই বড়দাকে চোর হিসেবে চিনে নেয়। আমাদের শিক্ষক বাবার মান সম্মান ধূলিতে মিশে যায়। 


কারো কোনো কিছু হারালে বড়দার উপর সবার সন্দেহ। গভীর রাতে প্রায়ই বাড়িতে পুলিশ এলে বড়দা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ দেখে মা কঁাপা গলায় বাবাকে বলেন ‘দিদারকে জেলে নিয়ে ওরা পেটাবে?’ বাবা কোনো কথা না বলে রাগে ক্ষোভে সাপের মত ফণা তোলেন। চোর সন্তান জন্ম দিয়ে যেনো তার মানব জীবন বৃথা। 


পদিপাড়ায় একদিন চুরিতে ধরা পড়ে বড়দা। তাকে খেজুর গাছের সাথে বেঁধে ক্ষ্যাপা জনতা ইচ্ছেমত পেটায়। মৃত্যুর আগে বড়দা ‘পানি দাও, পানি’ বলে আহাজারি করে। তাকে পানি দেয়া হয়নি। এতগুলি মানুষের সামনে পানি না পেয়ে বড়দা নিথর হয়ে গেল। 


২.

বড়দার এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন বাবা। তার ছেলেটা মৃত্যুর সময় পানি চেয়ে পানি পায়নি। বাকি জীবন তিনিও আর পানি খাবেন না। সত্যি সত্যি বাবা আর পানি স্পর্শ করেননি। হার্ট আর প্রেসারের ঔষুধ বাবা গিলে খান। পানি লাগে না। পানির গ্লাস চোখের সামনে ধরলে তিনি নাকি গ্লাসের ভেতর থেকে বড়দার কণ্ঠে ‘পানি দাও পানি’ শুনতে পান। 


বড়দার মৃত্যুর পর বাবা বেঁচে ছিলেন মাত্র তিন মাস। এক সাত সকালে ডালিম তলার চেয়ার থেকে মাথা ঘুরে তিনি পড়ে যান। মা পাগলের মত ছুটে গিয়ে দেখেন বাবার কেমন যেনো করছেন। উদাস গলায় মা শ্যামাকে ডাকলেন ‘কইরে তুই? তোর বাবা এমন করছে কেনো? পানি নিয়ে আয় তো!’ শ্যামা পানির গ্লাস নিয়ে এলো। মুখে পানি দিতেই বাবা গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে দু চোখ বন্ধ হয়ে গেল বাবার। তবুও তিনি পানি খাননি। হয়তো গ্লাসের ভেতর থেকে তিনি তখনও বড় ছেলের কণ্ঠে স্পষ্ট শুনতে পেলেন ‘পানি দাও, পানি।’ 


আমিশাপাড়া, নোয়াখালী। 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ