সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

গল্প -"অতঃপর ভালোবাসা"





 
অর্না খান


সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। রেনেসা বানু বারান্দায় বসে সুপারি দিয়ে জর্দা দিয়ে খুব মজা করে পান বানাচ্ছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার আজ খুবই আনন্দের দিন। মেয়ের পাগলামি দেখে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।তিনদির ধরে রেনু এ বাড়িতে।ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেনুর বাবা মৃত নিজামুদ্দিন ,তিনিও মেয়ের পাগলামি পছন্দ করতেন।
 রেনু উঠানে পা ছড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বসে আছে।লম্বা চুলে একটা এলোমেলো বেণী, বোধহয় ঘুম থেকে উঠে সে চুল আছড়ায় নি।কানের আশেপাশে,গালে বৃষ্টির পানিতে চুল ভিঁজে লেপ্টে আছে,গায়ে কমদামী সুতির শাড়ী তবুও রেনুকে সুন্দর লাগছে।এমন ভাদ্রমাসের বৃষ্টিতে রেনুর বেশ ভালো লাগছে।নিজেকে কেমন শুন্যে ভাসানো মেঘ মনে হচ্ছে।এখন যদি রাশেদ থাকতো নিশ্চয় বৃষ্টিতে ভিঁজতে বারবার না করতো। বৃষ্টি নিয়ে ওর মধ্যে কোনো উত্তেজনা নেই। যতটুকু সময় বাসায় থাকে বই নিয়েই সংসার তার। রাশেদের কথা মনে উঠতেই রেনুর ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
 
 রেনু উঠোন থেকে একবার বারান্দায় মায়ের দিকে তাকালো। রেনেসাবানুর চোখ ভেঁজা। রেনু ঠোঁটের কোণে পবিত্র হাসি টেনে ভেঁজা শরীরে মায়ের পায়ের কাছে গিয়ে বসলো।রেনেসা বানু দুহাত দিয়ে মেয়ের গাল ধরে কপালে চুমু খেলেন।এমন সব পরিস্থিতির জন্য রেনু সবসময় প্রস্তুত। বিয়ের আগেও সে দেখেছে মা প্রায়ই খুশি হয়ে কপালে দীর্ঘসময় নিয়ে চুমু খেতেন। বিয়ের পরে বাড়িতে এলেই মা সবার আগে এই কাজ করে। রেনেসাবানু চোখের ইশারায় মেয়ের কাছে কী একটা জিজ্ঞেস করলেন।
  রেনু মুখ নিচু করে বললেন,
"মা আমি আর ও বাড়ি ফিরে যাব না।"
রেনেসাবানু ছোট্ট করে হাসলেন। ভাবলেশহীন  একটা মুখ। 
 " বিকেলে তোমার পছন্দের পাটিসাপটা করবো।"
   রেনু আর কিছু বললো না।মায়ের হাসির কারণ টাও জানতে ইচ্ছে করছে না। রেনুর কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্ত কান্না পাচ্ছে না।খুব বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হলো।

     রাশেদ বিছানা ছেড়ে উঠবে উঠবে করেও গায়ের শক্তিতে আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না। রেনু বাসা থেকে গেল আজ তিনদিন।রেনু যাবার পরেরদিন থেকেই গায়ে কোনো শক্তি পাচ্ছেনা।আজ সকালে টের পেলো গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছে না।অথচ,পেটে ক্ষুদার উপদ্রব বেড়েই চলেছে। তিনদিন ধরে বই পড়া বন্ধ।অফিস কামাই যাচ্ছে,সিগারেটের প্যাকেট ফাঁকা।সব রাগ গিয়ে পড়ে রেনুর উপর।
  "বেয়াদব মহিলা,নিজে তো চলে গেলোই আমার সব শক্তিটুকুও যেন নিয়ে গেল।অসুস্থ স্বামীকে ঘরে রেখে বাবার বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে,এই মেয়েকে বনবাসে দেয়া উচিত।"
    রাশেদের রাগ কমেনা।বাহিরে বৃষ্টি দেখে রেনুর জন্য বুক হাহাকার জানায়।রেনু মেয়েটা বৃষ্টি ভালোবাসে,বড্ড বেশি ভালোবাসে।

 " দেখেছো,কেমন বৃষ্টি হচ্ছে? চলোনা একটু হেঁটে আসি!" শাড়ির এক কোণা ধরে বাচ্চা ছেলের মতো আবদার করে রেনু।
  "বাচ্চামি পরে হবে রেনু।আমি বইটা আগে শেষ করি। সিগারেটের প্যাকেট টা দিও তো।"
   রেনু ঘর থেকে বের হয়,সে জানে রাশেদ আসবে না,কিছুতেই আসবে না। বৃষ্টির সাথে সে রাতে তার অভিমান ভাগাভাগি করে নেয়। 
  রাশেদ ঘর থেকে ডাকে,
 "রেনু,আমায় এককাপ চা দিও।"
এই ডাককে রেনু অবহেলা করতে পারে না।অথচ, মানুষটার প্রতি তার কত অভিমান!
  সেদিন রাতের গল্প কেউ জানে না,কেউ জানেনা রেনুর অভিমানের কথা,কেউ জানেনা রাশেদ চা হাতে কোনো রেনুকে নয়,বৃষ্টিতে ভেঁজা কোনো দেবীকে দেখেছিল।

  আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে রাশেদ বর্তমানে ফিরে আসে।তার মন আরো খারাপ হয়।রেনুর বাচ্চামিগুলো সে কোনোক্রমেই পূর্ণতা দিতে পারেনি।তার দ্বারা হয় না,এটা নিশ্চয়ই রেনু জানে।তার এমন আধপাগল জীবনটাকে ভালোবেসেইতো রেনু নিজেকে সমর্পণ করে ছিল।তবে আজ কেন রেনুর এতো অভিমান? রাশেদের বুক ভার হয়ে আসে।

  "বটতলায় ফাঁকা সিগারেটের খোসা হাতে যে ছেলেটা,সেই ছেলেটাকে কি আমি চিনি?"
কোনো এক রুপসীর ডাকে সেদিন রাশেদ পিছু ফিরেছিল। এই পিছু ফেরাই যে তার জীবনকে এমন বেঁধে দেবে তা কি আর জানতো রাশেদ?
  " জ্যোৎস্না ও জননী পড়ে এলেন নাকি?" 
রেনু পাশে বসতে বসতে উত্তর দেয়,
  "মুখস্ত করে রেখেছেন একদম।"
"কয়েকবার পড়েছি।"
  "হুম জানি।"
রাশেদ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়।রেনু বলে,
  "রোজ দেখিতো এখানে বসে বই পড়েন।ক্লাশ করেন না কখোনো?"
  " বদ্ধ জীবন ভালো লাগেনা। কলেজের নিয়ম আমার দমবদ্ধ করে দেয়,এর থেকে আমার এই বইই ভালো।"
  "বেশ আধপাগল লোক আপনি।"
"পুরোটা হলে আর বই পড়তে পারবো না।তাই অর্ধেক হয়েই আছি।আজ আসছি।"
 রাশেদ চলে গিয়েছিল কিন্তু সাথে রেনুর মনটাও চলে ছিল তার পিছু।
রেনু সেদিন কথার ফাঁকে বড্ড হেসেছিল।আর রাশেদ বুঝে নিয়েছিল,সে বাঁধা পড়েছে,এক অদৃষ্ট বাঁধনে।
   কোনো এক বিকেলে রেনু তার কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে রাশেদের কনিষ্ঠ আঙুল ছুঁয়ে কবিতায় কবিতায় বলেছিল,
   "ধরো, কোনো একটা প্রিয় বই পড়তে পড়তে  ঠিক রহস্য উন্মোচনের সময়টাতে চলে এলে।আর আমি তখনি তোমার বইয়ে হাত রেখে,পড়া আটকিয়ে বললাম,ভালোবাসি।
 তুমি কি রেগে যাবে নাকি....."
রাশেদ রেনুকে থামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
"  পুরো বইটা শেষ করে তবেই বলবো
  ভালোবাসি ভালোবাসি।"
সেদিন রেনু হেসেছিল আবারো।আর রাশেদ দেখছিল এক অপ্সরীকে।

রাতে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যত বাড়ে,রেনুর কান্নার শব্দ ততই বাড়ে।রেনুর কান্নার কারণ সে জানেনা।ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে,কিন্তু মা কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলতে পারবে না। রাশেদের কথা বড্ড মনে পড়ছে। তিনদিনে কী অবস্থা করেছে নিজের কে জানে! যে আধপাগল লোক।রেনু ছাড়া কী করে থাকছে। বাকিটা জীবন রেনুকে ছাড়া কেমন করে চলবে? রেনু কাঁদে,এই কান্নায় শব্দ নেই।
   রাত তখন অনেক।বাহিরে বৃষ্টি বেড়েছে।দরজায় খটখট শব্দ শুনে রেনুর কান খাড়া হয়। এই এতো রাতে কেউতো আসবে না,তবে কে?
আবারো শব্দ হয়।রেনু ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
  "কে ওখানে?"
"রেনু,দরজাটা খোলো।"
রেনু থমকে যায়। এতো রাতে রাশেদ? কি করে সম্ভব?
আবারো রাশেদ শব্দ করে,
  "রেনু শুনছো?"
রেনু কাঁপা হাতে দরজা খোলে।রাশেদ ভেঁজা শরীরে দাঁড়িয়ে।বড় বড় চুল বেয়ে পানি পড়ছে,হাতে নিভে যাওয়া আধ খাওয়া সিগারেট,গালভর্তি দাড়ি,চোখ লালচে হয়ে আছে।
  রেনুর হাত ধরে রাশেদ ঘরে ঢোকে,
" রেনু,আমায় একটু পানি দাওতো।"
রেনুর চোখভর্তি পানি থইথই। 

করছে।জ্বরে রাশেদের গা পুড়ে যাচ্ছে। জামা কাপড় পাল্টে দিয়ে,রাশেদকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রেনু মায়ের ঘরে যায়।
এতো রাতে মেয়েকে পায়ের কাছে বসে কাঁদতে দেখে রেনেসাবানু চমকায়।
"উঠে আয়।কাঁদছিস কেন?"
"মা তোমার জামাই এসেছে।গা ভর্তি জ্বর।"
"বের করে দেব? তুইতো বললি ওর ঘর করবি না।চল তাহলে.."
রেনু উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
" নাহ,বের করে দিতে হবে না।আমার জামাই নিয়ে আমি কালই চলে যাব। ওর ঘর করবো নাতো কার ঘর করবো?"
রেনু নিজেও জানেনা কেন সে এ ঘরে এসেছে?কেন সে কাঁদছে।রেনু চলে যায়।রেনেসাবানু মুচকি হাসে।মেয়েটা তার পুরো পাগল,আর জামাই আধপাগল।

"এমন জ্বর ওঠালে কি করে?"
"সব দোষ তোমার।নিজেতো এসেছো,আমার সব শক্তিটুকুও একদম সাথে করে নিয়ে এসেছো।"
রেনু কিছু বলেনা।কপালে জলপট্টি দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ বাদে রেনুর হাত কপালে চেপে ধরে রাশেদ বলে,
"এই যে,আমার এতো জ্বর।এখন যদি তোমার জলপট্টি দেয়া বন্ধ করে হাতে হাত রেখে বলি
ভালোবাসি,তুমি কি রেগে যাবে নাকি...."
রেনু থামায় রাশেদকে।চোখের জ্বল ছেড়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
"ভালোবাসি গো বড্ড ভালোবাসি।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ