সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

পুরী আছে পুরীতেই


ড. গৌতম সরকার

মুখবন্ধ: পুরী বেড়ানোর কথা উঠলে এক সমুদ্র আনন্দঢেউ বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়না এমন বাঙালী খুব কম আছে। পুরী সবসময়ই বাঙালীর হৃদয়ের বড় কাছাকাছি থাকে-সমুদ্র, বালি, ঢেউয়ের গর্জন, জগন্নাথ দেব, মোহনা, বিকেলের বিচে বসে চা বা রসগোল্লা খাওয়া, আর একদিনের সফরে উদয়গিরি, ধবলগিরি, খন্ডগিরি, নন্দনকানন, কোনারক প্রতিবারই পুরী ভ্ৰমনকে স্মরণীয় করে রাখে। ভ্রমণ প্রিয় বাঙালী পাঁচ-সাত-আট-দশবার পুরীর সমুদ্রে গা ডোবাননি, এমন খুঁজে পাওয়া কঠিন৷


প্রথম দৃশ্য:  হাওড়া স্টেশনের বড়ঘড়ির ঠিক নিচে লাগেজের একটা বড় স্তুপ, স্তুপ না বলে পাহাড় বললেই ভালো হয়। পাশে বেশ কিছু নারী-পুরুষ-বাচ্চা-বুড়োর জমায়েত। সবাই কথা বলছে, কিন্তু কেউ কারোর কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছেনা। ইতিমধ্যেই বড়দের হাতে হাতে চায়ের কাপ, আর বাচ্চাদের হাতে চিপ্স আর কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল শোভা পাচ্ছে। হাসি-গুলতানি বেশ জমে উঠেছে। দলটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে একজন মানুষ গুলতানিতে যোগ না দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে পায়চারি করছেন আর মাঝেমাঝেই ঘড়ি দেখছেন৷ বারবার ভিড়টার কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কিছুর বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু খুব বেশি পাত্তা পাচ্ছেননা। উদ্বিগ্নমুখ ভদ্রলোক হচ্ছেন মিস্টার সেন, তিনি এই ট্যুরের অঘোষিত ম্যানেজার আর তাঁর উদ্বেগের কারণ হলো ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দেওয়ার সময় হয়ে গেল, মিস্টার পালের এখনও দেখা নেই।


দ্বিতীয় দৃশ্য: ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। মিস্টার সেনকে গলাভর্তি টেনশনে রেখে মিস্টার পাল বউ আর বাচ্চা নিয়ে প্রায় শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছেন এবং বলাইবাহুল্য সেনের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ঝাড় খেয়েছেন। তবে এখন সব ঠিকঠাক, থ্রি-এসি কামরায় নরক গুলজার চলছে। প্রাথমিকভাবে কে জানালায় বসবে আর কে সাইড লোয়ারে পা ছড়িয়ে যাবে সেটা নিয়ে একটা বচসা শুরু হয়েছিল, কিন্তু মিস্টার সেন শক্ত হাতে সে সমস্যা মিটিয়েছেন। অঘোষিত হলেও দলের সবাই মিস্টার সেনের ম্যানেজারিত্ব বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। এখন চলছে হালকা খাওয়া পর্ব, উপাদেয় তো বটেই তার সাথে এই পর্বটা বেশ উপভোগ্যও বটে। ঘোষবৌদির ব্যাগ থেকে বিস্কুট বেরোচ্ছে তো মিত্র বৌদির ব্যাগ থেকে ধীরে ধীরে বেরোলো কে.সি.দাশের রসগোল্লা; মিত্র গিন্নি মৃদু হেসে টলতে টলতে সকলকে রসগোল্লা বাটতে লাগলেন, ঘোষ বৌদির বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জিতে যাওয়া হাসি দিয়ে তার হাতে জোর করে দুটো রসগোল্লা ধরিয়ে দিলেন। ওদিকে সেন গিন্নির ঝোলা থেকে হলদিরামের লাড্ডু বেরোতে দেখে গিন্নির কাছে কড়া ধমক খেযে মিস্টার বোস তড়িঘড়ি সিটের নিচ থেকে ঢাউস ব্যাগটা বের করলেন। সেটা থেকে বোস গিন্নির জাদুছোঁয়ায় বেরিয়ে এল ভীমনাগের কড়াপাকের সন্দেশ। এর মধ্যেই দত্ত বৌদি মুখার্জী বৌদির মুখে জোর করে লেডিকেনি গুঁজে দিচ্ছে দেখে নস্কর গিন্নি মনে মনে 'আদিখ্যেতা' আওরে ট্রেনের দুলুনিতে দুলতে দুলতে পাশের কামরায় চললেন ভিখারাম চাঁদমলের কাজু বরফি বিলি করতে। ট্রেন ট্রেনের মত চলতে লাগল, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলল ট্যুরের প্রাথমিক পর্ব জিতে নেওয়ার সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা।


তৃতীয় দৃশ্য: সূর্য ডুবে গেছে, আস্তে আস্তে সমগ্র চরাচর অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে। বিকেলে সবাই মিলে মোহনা ঘুরে এখন ঘোষ, বোস, মিত্তির, সেন, দত্ত সমভিব্যহারে বালির ওপর চেয়ারে বসে আছেন। বড়দের সবার হাতে চায়ের কাপ, বাচ্চাগুলো বালিতে হুটোপুটি করছে। ছেলেদের গল্পে আসন্ন বিধানসভা আর মহিলাদের গল্পে সিরিয়াল, সাজগোজ আর পুরীতে এবারে কি কি শপিং করবে তার ফিরিস্তি চলছে, এমন সময় পাশ দিয়ে একদল ছেলে-বুড়ো-মহিলা-বাচ্চা কলবল করতে করতে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে ছুটে গিয়ে চটি-জুতো শুদ্ধ পা সমুদ্র জলে ডুবিয়ে দিল। সেন গম্ভীরভাবে বললেন, এরা বিকেলের ট্রেনে এসে পৌঁছেছে। সবাই অবাক চোখে সেনের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝে গেল। এরা হোটেলে চেক-ইন করেই তড়িঘড়ি সমুদ্রপারে এসেছে। তাই উৎসাহের প্রাবল্য স্বাভাবিক কারণেই একটু বেশি। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল বাইরের পোশাকে এরা অনেকেই জলে নেমে স্নান করতে লেগে গেছে।


চতুর্থ দৃশ্য: সকালে জগন্নাথদেবের মন্দিরে খুব নিষ্ঠাভরে পূজো দিয়ে সবাই বকবক খুশি। একটু বেলায় দেখা গেল কর্তারা হাফ প্যান্ট, আর গিন্নীরা নাইটি আর দোপাট্টা গায়ে জড়িয়ে সমুদ্র কিনারা থেকে একটু তফাতে চটি জুতা রেখে ডাব খেতে খেতে সমুদ্র স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিজ্ঞ চোখ বলে দেবে আজ পুরীতে এদের দ্বিতীয় দিন। দাদা-বৌদির হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম নিয়েছেন। ভাত পেটে দিবানিদ্রার কারণে কর্তা-গিন্নীদের মুখ ফোলাফোলা। বাচ্ছারা অবশ্য সে রাস্তার না হেঁটে হোটেলের চত্বরের মধ্যে খেলে কাটিয়েছে। সন্ধ্যার মুখে সি-বিচে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে গিন্নীবাহিনী হোটেলে ফিরে পছন্দের সিরিয়াল দেখে সময় কাটানো মনস্হ করলেন৷ 


পঞ্চম দৃশ্য: আজ দাদারা বেরিয়েছেন পাঞ্জাবী-পাজামায় আর বৌদিরা সালোয়ার-কামিজ শোভিত হয়ে। সমুদ্রের বালি এড়িয়ে কেউ বসেছেন মেরিন ড্রাইভের ব্যুলেভার্ডে, আবার কেউ সন্নিহিত রেস্তোরাঁয়। বাচ্চাগুলো বার বার সমুদ্রমুখী হতে চাইছে আর বোস-ঘোষ-মুখার্জী-নস্কর গিন্নীরা বড় বড় চোখ করে তাদের নিরস্ত করছেন আর মুখ কুঞ্চিত করে নিজের নিজের বাচ্চাদের জামা প্যান্ট থেকে বালি ঝেড়ে দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন; অন্যদিকে পুরুষমণ্ডলী সমুদ্রের দিকে পিছন ফিরে কেউ কফির কাপে, কেউ মাছভাজা আর কেউ কেউ সিগারেটের ধোঁয়ায় তুফান তুলছেন। যেকোনো অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলবে, পুরীতে এদের আজ তৃতীয় দিন।


ষষ্ঠ দৃশ্য: পুরীতে দিনেরবেলা সূর্যের কিরণ অসহ্য; রাস্তাঘাটে সকাল নটার পরই লোকজন কমতে শুরু করে। ভরদুপুরে স্বর্গদ্বারেও কয়েকটি ঘেয়ো কুকুর আর পাগল ছাড়া কেউ ঘুরে বেড়ায় না। হঠাৎ চোখে পড়ল মুখার্জীদা মুখার্জী বৌদির পিছন পিছন রাস্তার ধারের কাপড়ের দোকানগুলোয় ঢুকছেন আর বেরোচ্ছেন; বিকেলে মুখার্জীদার সাথে যোগ দিলেন ঘোষদা, বোসদা, মিত্তিরদা, সেনদা, নস্করদা। প্রায় সবাই হাফপ্যান্ট আর কটকির পাঞ্জাবী পরে অত্যন্ত বেজার মুখে দুহাতে উপচে পড়া জিনিসপত্র নিয়ে বৌদের পিছনে পিছনে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এরা আজকে ভুল করে একবারও সমুদ্রের দিকে তাকাননি। অভিজ্ঞ চোখ সহজেই বলে দেবে কাল ওনারা নিজ নিজ বাড়ি ফিরবেন, আজ পুরীতে ওদের চতুর্থ বা শেষ দিন। 

 

শেষ দৃশ্য: আবার ট্রেন চলতে শুরু করেছে, তবে এবার উল্টোমুখে। আর কামরাতেও উল্টোপুরাণ চলছে। পরিষ্কার কানে আসছে মিত্তিরগিন্নী গজগজ করছেন কেন তাদের টিকিট আলাদা কম্পার্টমেন্টে হলনা। মিত্তিরদা কোনো উত্তর দেওয়া নিরাপদ হবেনা জেনে অন্যদিকে চেয়ে উদাসমুখে বসে আছেন। ওদিকে ঘোষগিন্নী প্রচন্ড বিরক্ত মুখে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন কারণ সামনের সিটে নাগগিন্নী ছেলের সাথে যে ন্যাকামি শুরু করেছে তা চোখ চেয়ে দেখা যায়না। ওদিকে পালগিন্নী ছেলেকে ধরে বেধড়ক পেটাচ্ছেন আর বলে চলেছেন, চল তুই, বাড়িতে একবার পৌঁছাই, তোর হয়েছে কি! বড্ড বাড় বেড়েছে! খালি খেলা আর খেলা, বাইরে বেরিয়ে সাপের পাঁচ পা দেখেছো? বাড়ি চলো, তোমাকে সাইজ করছি! দিনে ফিফটি সামস আর টেন পেজেস হ্যান্ড রাইটিং করতে হবে, মনে রেখো। বাচ্চাতো অবাক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে- বেচারি শিশু বুঝতে পারেনা তার অপরাধটা কি! আসার সময় যেমন বন্ধুদের সাথে খুনসুটি করতে করতে এসেছিল, ফেরার সময়ও তো তাই করছে, তাহলে মা এত রেগে গেল কেন! হায়রে শিশু! তোদের বাপ-ঠাকুরদা, তস্য তস্য পিতাপিতামহরাই কোনোদিন নারী চরিত্র বুঝে উঠতে পারেনি, আর তোরা তো নেহাত অবোধ। একফোঁটা কি করে বুঝবি মানব চরিত্র! শুধু বাচ্ছারাই বা কেন, ওই রসগোল্লা, লাড্ডু, ক্ষীরের সন্দেশ লেডিকেনিগুলোর যদি ভাবার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তারাও কি ওই একই ভাবনার শরিক হতোনা!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ