সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-১২]

 


লেখা- পার্থসারথি

ঋতেশ বাবু, প্রভাময়ী দেবী ও অভীক মজুমদার নাস্তার টেবিলে। পারমিতার জন্য অপেক্ষা। অভীক মজুমদার লজ্জায় গুটিশুটি মেরে চুপচাপ বসে আছেন। দৃষ্টি সীমানা খুবই কাছে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে অভীক  মজুমদারের । ঋতেশ বাবু কাজের মেয়েটিকে দিয়ে পারমিতাকে ডেকে পাঠালেন।

পারমিতার দু’চোখ অসম্ভব রকম ফোলা ফোলা এবং লাল হয়ে আছে। মাটিতে দৃষ্টি রেখে পারমিতা এগিয়ে এল। বাবার পাশের চেয়ারটায় বসল। কারও দিকে এক পলক তাকায়নি পারমিতা। অন্যদিন হলে দাদাবাবু কী খাচ্ছেন না-খাচ্ছেন তার খোঁজ-খবর নিত। অভীক মজুমদারও যথারীতি সুবিধা-অসুবিধা অকপটে বলতেন। কিন্তু আজ চোখ তুলে একবারও পারমিতার দিকে তাকালেন না। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছেন। নাস্তাটা শেষ করেই অভীক মজুমদার যেন পালিয়ে বাঁচলেন।

পারমিতা সেই তখন থেকে প্লেটে খুটে খুটে খাচ্ছে। ঋতেশ বাবু মেয়ের দিকে তাকালেন এই প্রথম। মেয়ের অবস্থা দেখে বুকটা হু, হু করে কেঁপে ওঠল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মেয়েকে বললেন কেন মা নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস। তোর ভালোর জন্যই তো আমরা এরকম ভাবছি। 

প্রভাময়ী দেবী এবার ক্ষেপে উঠলেন, বললেন মেয়েদের এতো নানা বাহানা থাকলে চলে না। মা-বাবার কথা শুনতে হয়। কোন মা-বাবা তাদের সন্তানের অমঙ্গল চিন্তা করে না।

পারমিতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- আমি কি তোমাদের কিছু বলেছি? আমার কষ্টটাকেও আমি নিজের মত করে লালন করতে পারবো না? তোমরা যা বোঝো কর। কথাগুলো বলে আবার শান্তভাবে বাবাকে বলে বাবা, আমি একটু ক্যাম্পাসে যাচ্ছি দুপুরের আগেই চলে আসব। 

‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কোন কথার জন্যই পারমিতা অপেক্ষা করে নি। সোজা নিজের রুমে চলে আসে। চুলে চিরুনিটা বুলিয়ে পার্টসটা তুলে নেয় হাতে। তারপর বাইরে বেরিয়ে আসে।

এত সকালে পারমিতাকে আশা করে নি রুচিরা। পারমিতাকে উদভ্রান্ত মনে হচ্ছে। পুরো শরীরে একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে রুচিরা বলে- পারমিতা তোমার কী হয়েছে? দেখে মনে হচ্ছে কাল সারারাত ঘুমোও নি।

পারমিতা দৃষ্টি লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। রুচিরা আরও কাছাকাছি হয়ে বসে। গভীর দৃষ্টি নিয়ে রুচিরা পারমিতাকে দেখে। চোখ দেখেই বোঝা যায় পারমিতা কষ্টের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। পারমিতাকে দেখে রুচিরার কষ্ট হচ্ছে। রুচিরা একহাতে পারমিতাকে আগলে ধর ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বলে প্লিজ, আমাকেও কষ্টে ফেলো না। সব খুলে বল আমাকে।

পারমিতা রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পারমিতার পিঠে হাত রেখে রুচিরা বলে - শান্ত হও পারমিতা, শান্ত হও।

পারমিতা সব কথা রুচিরাকে খুলে বলে। সব কথা শোনার পর রুচিরা কথা বলার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। যেন বিস্ময়তায় কেটে গেল হাজার নিঃশ্বাসের মুহূর্তে। নীরবতা ভেঙে পারমিতা বলে দিদি, তুমি সৈকতকে একটু বুঝিয়ে বলো, ও যেন আমাকে ভুল না বোঝে।

রুচিরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারপর একটা র্দীঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পারমিতাকে বলে যদিও তোমার কিছু করার ছিল না। কিন্তু সৈকত খুবই কষ্ট পাবে। কারণ তোমাকে নিয়ে ও অনেক সবপ্নের  ভুবন তৈরি করে নিয়েছে। ওকে যে কিভাবে বুঝিয়ে বলব! চিন্তা করে কোন  কূল কিনারা পাচ্ছি না। তবে মুখ্য ভূমিকা তোমাকেই পালন করতে হবে।

প্লিজ দিদি, আমি ওর মুখোমুখি হতে পারবো না। ওর কষ্ট দেখে আমি সহ্য করতে পারব না। তুমিই ওকে বুঝিয়ে বলো।

তুমি নিজে গিয়ে বললে ভালো হতো না।?

না দিদি, আমি যেতে পারব না? তুমিই বুঝিয়ে বল।- পারমিতা আকুল মিনতি করে রুচিরাকে বলে। 

রুচিরা কিছু একটা ভাবে। তারপর পারমিতাকে বলে- ঠিক আছে,  তুমি চিন্তা করো না। আমি সৈকতকে সব বুঝিয়ে বলবো।

পারমিতা একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে বলে রুচিদি, তুমি খুব ভালো।

জবাবে রুচিরা শুধু হাসে।

অল্পক্ষণ পরই রুচিরা সৈকতের উদ্দেশে রওনা হয়। ঘটনা শোনার পর থেকেই রুচিরার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। আর এখন গিয়ে কীভাবে যে কথাটা উত্থাপন করবে তার শুরুটাই ভেবে পাচ্ছে না।

দরজার কড়া নড়ে ওঠতেই সৈকত এগিয়ে আসে। দরজা খুলেই সৈকত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুচিরাকে দেখে।তারপর পাশ ছেড়ে দাঁড়িয়ে সৈকত বলে দিদি এসো, ভেতরে এসো।

চেয়ার টেনে রুচিরা বসে। কাছাকাছি হয়েই খাটের উপর সৈকত বসে। রুচিরা মনে  মনে ভাবে; কোত্থেকে, কিভাবে শুরু করবে। সৈকত রুচিরা দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু একটা শুনবে এমন প্রত্যাশায়। কিন্তু রুচিরা চুপচাপ বসেই থাকে। 

নীরবতা ভেঙে সৈকত বলে এভাবে চুপচাপ বসে আছেন যে? তাছাড়া আপনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। 

রুচিরা এড়াতে চেষ্টা করে- না এমনিতইে। হঠাৎ ভাবলাম তোমার এখান থেকে একটু ঘুরে যাই।

এসে ভালো করেছেন। আমিও ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। কারণ একা একা বোরিং লাগছে। 

কেন? অনিক কোথায়?

দু’দিন হল বাড়িতে গেছে।

সৈকত তুমি পারমিতাকে খুব ভালোবাসো, তাই না?

সৈকত লজ্জাবনত হয়ে উচ্চারণ করে- কেন দিদি, হঠাৎ করে এই প্রশ্ন।

রুচিরা কোন কথা বলে না। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকায়, দৃষ্টিতেই বোঝা যাচ্ছে যে রুচিরা উত্তর চাচ্ছে। 

রুচিরার দিকে না তাকিয়েই সৈকত বলে-  রুচিদি  সত্যি বলতে কী, পারমিতাই  আমার জীবনের প্রথম নারী যাকে আমি মনের ভেতর ঠাঁই দিয়েছি। 

পারমিতাও নিশ্চয়ই তোমাকে খুব ভালোবাসে?

আমার বিশ্বাস আমি যতটুকু ভালোবাসি সেও তেমনি আমাকে ভালোবাসে। কথাগুলো সৈকত বলছে ঠিকই কিন্তু মনের ভেতর কিছু প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে যে, রুচিদি হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন করছে কেন? 

তুমি ঠিকই বুঝতে পেরেছ। পারমিতা তোমাকে খু-উ-ব ভালোবাসে।

কথাটা শোনার পর সৈকতের পুরো মুখণ্ডলে হালকা খুশীর বন্যার ঢেউ খেলে গেল যেন। রুচিরার চোখে বিষয়টা ধরা পড়ে। কিন্তু রুচিরা বেশ কষ্ট পায়। রুচিরা কোন কথায় আর এগোবার সাহস পাচ্ছে না। সৈকত অপেক্ষায় আছে পরবর্তী কথা শোনার জন্য ।

সৈকত, জীবনে কিছু ঘটনা আচমকা ঘটে যায়। যার জন্য, কেউ কখনও প্রস্তত থাকে না এবং অনেক সময় তা একটা জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তবে জীবনের জন্য ওইসব ঘটনাকে মোকাবিলা করতে হয়। বুদ্ধিমত্তার সাথে যারা মোকাবিলা করে তারাই প্রকৃত জীবন যোদ্ধা। কথাগুলো সৈকতের মনে আরও প্রশ্ন জাগায়। কিন্তু সৈকত কিছু প্রশ্ন করল না । প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুচিদির দিকে। রুচিরার সুন্দর মুখটা যেন নীলচে হয়ে আছে। পারমিতার জমাট বাঁধা কষ্টগুলো রুচিরার ভেতরে ক্রমশ বেড়ে চলছে। নিরুপায় হরিণীর মত ছটফট করছে রুচিরার দেহ-মন।

র্দীঘ নীরবতা ভেঙে সৈকত বলে রুচিদি, আমার মনে হচ্ছে আপনি অন্য কিছু একটা বলবেন। নিঃসন্দেহে বলতে পারেন।

রুচিরা এবার সাহসের বুকে ভর করে এগোবার চেষ্টা করে বলে-  সৈকত পারমিতা খুবই বিপদে পড়ে গেছে।

সৈকত বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে ওর কী হয়েছে দিদি?

পারমিতা তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসে। কিন্তু একটা বেসামাল পরিস্থিতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে সে।

সৈকত চুপচাট। আগ্রহভা দৃষ্টিতে সৈকত তাকিয়ে আছে। রুচিরা সবকিছু খুলে বলে। সবকিছু শোনার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় সৈকত অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে রুচিরার দিকে তাকিয়ে থাকে। কান্নার জল চোখের কোণে কোণে এসে জমে আছে। বেদনায় বিদ্ধ সৈকতের পুরো মন। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে সৈকত বলে রুচিদি, তুমি বলে দাও। এখন আমি কি নিয়ে বাঁচবো! পারমিতাকে নিয়েই আমি সুন্দর সুন্দর স্বল্প এঁকেছি। আমার স্বপ্নের বাগানে একটিই ফুল, সে হল পারমিতা। ওকে ছাড়াতো আমার সূর্যোদয় হবে না। বলতে বলতে সৈকত শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে। 

রুচিরা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায় । সৈকতের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে- সৈকত এত ভেঙে পড়লে চলবে  না। তাছাড়া পারমিতা তোমাকেই ভালোবাসে। না পাওয়ার মাঝেও তো এক রকমের সার্থকতা লুকিয়ে আছে।

এইসব আমি বিশ্বাস করি না। যা বুকের মধ্যে লালন করব তা যখন পাব না তখন সার্থকতা থাকার প্রশ্নই আসে না।  পারমিতা আমাকে চিট করেছে।

তুমি ওকে ভুল বোঝ না, সৈকত। তুমি যদি ওকে দেখতে ওর কী অবস্থা, তাহলে এ কথা বলতে পারতে না।

সব মিথ্যে। আমি কিছুই বিশ্বাস করি না।- এই বলে সৈকত দু’হাতে চোখ-মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে থাকে।

পারমিতা তোমার কাছে আসবে। ও ক্ষমা চেয়ে তোমার আর্শীবাদ চেয়েছে। শেষের কথাটায় সৈকত মুখ তুলে তাকায়। তারপর ছলছল চোখের কোণ বেয়ে উপচে পড়ল অশ্রু ফোঁটা।

কান্না জড়ানো কন্ঠে সৈকত বলে ভেবেছে কি, ওকে আমি অভিশাপ দেব? 

না, ঠিক তা নয়। পারমিতা তোমাকে খুব ভালোবাসে। সে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। আসলে ব্যাপারটাও একেবারে ক্রিটিক্যাল।

সৈকত আর কোন কথা বাড়ায় না। দু'জন র্দীঘক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। সময় বয়ে চলে আপন গতিতে ……………………...


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ