সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

বাঙালির বর্ষবরণ : "এসো হে বৈশাখ, এসো এসো"

 


ডঃসুবীর মণ্ডল

বিষুবরেখার  এপারে এখন  রোদ্দুরের তেজ বাড়ছে  প্রতিদিন, একটু একটু করে  বাড়ছে  দিনের দৈর্ঘ্য। প্রকৃতির  এই পালাবদল জানান দিচ্ছে--বৈশাখ আগত ওই।আর বৈশাখ মানেই তো গ্রীষ্মের  প্রথম ডাকহরকরা।গ্রীষ্ম মানে ঝকঝকে  ভোর আর সারাদিন  রোদ্দুরের আগুনে নিঃশ্বাস; গ্রীষ্ম মানে- অলস তৃষ্ণার্ত দুপুর আর গোধূলিস্নানের এক আকাশ তৃপ্তি ,সেই সঙ্গে গ্রীষ্ম মানে  বাংলা বছরের শুভ মঙ্গলময়   সৃচনাও।বর্ষারম্ভের বিশেষ ক্ষণকে স্বাগত  জানবার জন্যে এ -বছরও দুই বাংলার বাঙালির  উৎসাহ ও উদ্দীপনার শেষ নেই।সবাই বৈশাখকে মনের অমল আকুতি দিয়ে  আহ্বান করে বলতে  চাইছে--"এসো হে বৈশাখ, এসো এসো "

বিদায় ১৪২৭। স্বাগত ১৪২৮। করোনার আবহেও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে  প্রস্তুত  দুই বাংলার  কোটি কোটি বাঙালি। আগামী  ১৪ ও ১৫ই এপ্রিল দুই দেশের  বাঙালির জাতির কাছে ঐতিহ্যবাহী  বর্ষবরণের দিন। নতুন বছর মানেই নতুন  আশা  আর প্রত্যাশার যুগলবন্দি।  পহেলা বৈশাখ  প্রতি বছরেই আসে বাঙালির জীবনে ও মানসে।  অন্তহীন  প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাঙালির মনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে। এ-এক পরমপ্রাপ্তি আমাদের বাঙালি জাতির।  বর্ষবরণে মেতে উঠবে  আট থেকে আশির মানুষ। ইচ্ছাপূরণ আর স্বপ্নপূরণের বর্ণময় উৎসব নববর্ষ। কিন্তু আমরা  একটা  দুঃসময়ের মুখোমুখি। গত বছর করোনার আবহে বর্ষবরণ উৎসব  প্রাণের আকুতি দিয়ে      অনুষ্ঠিত হয়নি  তেমনভাবে,এবার বর্ণময়  হয়ে উঠবে  কিনা সে বিষয়ে    শংসয়ের যথেষ্ট  অবকাশ আছে। বর্তমানেও বিশ্বজুড়ে মোহময় দুঃসময় চলছে দীর্ঘসময় ধরে। বিশ্ব জুড়ে  করোনার  ক্ষত শুকিয়ে  যেতে  না যেতে  দ্বিতীয়  ঢেউয়ে  টালমাটাল  অবস্থা।  মৃত্যুর মিছিল  থামেনি, নতুন করে  আক্রান্তের খবর আসছে।


করোনার দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউ  আছড়ে পড়ছে  সমগ্র বিশ্বসহ এপার বাংলার  কলকাতা সহ ভারতের বেশ  কয়েকটি  শহরে সংক্রমণ  বেড়ে চলেছে।  সেই সঙ্গে      করোনার ভয়াবহতা কমলেও আমরা   কেউ  পুরোপুরি   করোনা থেকে মুক্ত  নই।তবুও  নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আপামর  বাঙালি  । সেই সঙ্গে  অর্থনৈতিক দিক থেকে  দেশের  সাধারণ মানুষ  অনেক  খানি কমজোরি  হয়ে  পড়েছে। উৎসব পালনের সাধ  থাকলেও সাধ্যির  মধ্যেই বেশ  ফারাক পরিলিক্ষত হচ্ছে। নতুন বছর মানেই হইহুল্লোড়,ইচ্ছা মতনই খাওয়া-দাওয়া, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, হাতখাতাখোলা,আর কত কী !কিন্তু এ-বছরটা অন্য বছরের থেকে আলাদা  কারণ করোনা সংকটে  হতাশা আর আশঙ্কার কালো মেঘ জমেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। যদিও  মহামারির  তীব্রতা কিছুটা  কমলেও  পুরোপুরি কেউ  বিপদ মক্ত  নই।তবুও রাত শেষে নতুন দিনের সূর্য উঠবেই। এমনটাই মনে করে  কোটি কোটি  দুই দেশের বাঙালি। দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ ছিল  বহু দিন।সামাজিক যোগাযোগ ও দূরত্ব বজায় রাখতে  হয়েছিল দীর্ঘদিন।  আত্মীয় স্বজনের  সঙ্গে  মিলিত  হওয়ার  কোন সুযোগ  ছিল না। পহেলা বৈশাখের শুভকামনা বার্তা পাঠানো হয়েছে  মুঠিফোনের মাধ্যমে। এটা অত্যন্ত ব্যথা ও দুঃখের বিষয়। তবে  এবার পহেলা বৈশাখ আর একলার   বৈশাখ  হবে না  হয়ত! হাতে হাত ধরে আগামীকে   ভালো  রাখার শপথ বাক্য পাঠ করব সকলকেই। ১৪২৮-এ বিশ্ব থেকে করোনা মুক্ত হোক । 

 


উৎস  সন্ধানে : 

পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর ১৫ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়।  এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।

বাংলা দিনপঞ্জীর সাথে হিজরী এবং খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর আর খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুর হয় ইউটিসি±০০:০০ অনুযায়ী। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যোদয় থেকে শুরু এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।




পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ মাছ, বিভিন্ন ধরনের ভর্তা এবং কাচা মরিচ পরিবেশন

হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।



ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।



আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সনের পূর্বে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।

 

পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে বাঁধা পড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আনন্দে। সারা চৈত্র মাস জুড়েই চলতে থাকে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুবসংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। এইদিনেই সূর্য মীন রাশি ত্যাগ করে মেষ রাশিতে প্রবেশ করে। এদিন গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীগণ বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। এছাড়া বহু পরিবারে বর্ষশেষের দিন টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা একবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান সেরে বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুলপ্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে, যার পোশাকি নাম হালখাতা। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়।


 

ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম 'চৈত্র সেল'। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে, এছাড়া দক্ষিণেশ্বর ও তারাপীঠে  বহু  মানুষের  সমাগম ঘটে, সেই সঙ্গে  চিড়িয়াখানা,নিউটাউনের মিলেনিয়াম পার্ক, সল্টলেকের  নলবন,ভিক্টোরিয়ার  চত্বরে  তিল ধারণের জায়গা থাকে না। তিলোত্তমা নগরী  কলকাতা বর্ষবরণে  নতুন করে  সেজে  ওঠে। আট থেকে  আশির স্বপ্নপূরণের ঠিকানা বাংলা  নববর্ষ।খেতে ও খাওয়াতে  ভালো বাসে বাঙালি।  নববর্ষের  হাত ধরেই তাঁর   স্বপ্নপূরণ ঘটে। আকাশ  ছোঁয়া দাম হলেও  প্রত্যেকের পাতে থাকবে  ইলিশ,বাগদা, গলদা, পাবদা ও ভেটকি। সঙ্গে  মিষ্টি  থাকবেই।  গ্রামের  পুকুরে  জাল ফেলে  বড় বড়  রুই,কাতলা  ধরার ধুম । একটা  উৎসবের  মেজাজ ছড়িয়ে পড়ে  গোটা  বাংলায়, । ধনি-দরিদ্র  নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে উৎসবের  আঙিনায়  সমবেত হয়। এ-এক পরম  প্রাপ্তি। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত।

 নববর্ষ  ও বাঙালির  আবেগ : বাংলা নববর্ষের  উৎসব  আছে  বলেই বাঙালির পরাজয় নেই,নেই  দুর্যোগ, শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার ভয় পাওয়ার  আশঙ্কাও, এই উৎসব জাগরণের ঘন্টাধ্বনি বাজায়।জাগায় শোষণ ও বঞ্চনার শৃঙ্খল ভাঙার  প্রেরণা, উৎসাহ-উদ্দীপনা।     পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন একটা  সুমহান আহ্বান  থাকে।মুছে  যাক সব গ্লানি, মুছে  থাকব জরা- জীর্ণতা।কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'নববর্ষ ' প্রবন্ধে  লিখেছেন--" এই মহিমান্বিত জগতের অদ্যকার নববর্ষ দিন আমাদের জীবনের  মধ্যে যে গৌরব বহন করিয়া  আনিল---------এই পৃথিবীতে বাস করিবার  গৌরব,আলোকে  বিচরণ করিবার গৌরব, এই আকাশ তলে আসীন হইবার গৌরব, তাহা যদি  পরিপূর্ণভাবে  চিত্তের মধ্যে গ্রহণ করি,তবে আর বিষাদনাই,নৈরাশ্য  নাই, ভয় নাই, মৃত্যু  নাই, "

এই আহ্বান চিরন্তন ও অবিকৃত থাকুক। অটুট থাকুক পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা। আসলে এই উৎসবের থেকেই বাঙালির জাতীয় ঐক্যের সুমহান আদর্শ  জাগ্রত হয়। জাতীয়  জীবনের  সব অনৈক্য, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সব বিভাজন দূর হয়ে যায়।  বাঙালির  নববর্ষ উদযাপন হোক শান্তির এক মহানীড়।আনন্দলোক ও মঙ্গলালোকে বিরাজ করুক সত্য ও সুন্দর।  

দীর্ঘ বারো মাসের পাওয়া না পাওয়াকে পেছনে ফেলে নতুন আশার আলো নিয়ে আসে বছরের প্রথম দিন। এদিনে পুরনো বছরের ব্যর্থতা, নৈরাশ্য, ক্লেদ-গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন ভাবে নতুন পথ চলার শুরু হয় স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায়। 

  বাঙালির জাতিসত্তায় নববর্ষ:    পৃথিবীর প্রতিটি জাতিসত্তার কাছে সেই জাতির ঐতিহ্যগত নতুন বছরের সূচনা পরম পবিত্র বলে গণ্য হয়। বাঙালিও এর ব্যতিক্রম নয়। সাধারণ বাঙালি জীবনে বছরের যে কয়েকটি দিন সকল প্রকার ক্লেদ এবং গ্লানিকে ভুলিয়ে মনের অন্তঃস্থলে নতুন আনন্দের উচ্ছ্বাস জাগিয়ে তোলে, সেই দিনগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা নববর্ষের সূচনাকাল।

বাংলা নববর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বসন্ত ঋতুর অন্তিম মাস চৈত্রের অবসানে বৈশাখের সূচনার মধ্যে দিয়ে বাঙালি নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। বর্ষবরণের অনাবিল আনন্দে উদ্ভাসিত বাঙালির জীবন পুরাতন বছরের সকল দুঃখ ও গ্লানির কথা ভুলে নতুন করে বাঁচার আশায় বুক বাঁধতে থাকে। এই প্রসঙ্গেই কবি লিখেছেন- 

নিশি অবসান,ওই পুরাতন

বর্ষ হলো গত

আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন

করিলাম নত

বন্ধু হওশত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও

ক্ষমা করো আজিকার মতো

পুরাতন বছরের সাথে

পুরাতন অপরাধ যতো।”


বাংলা বর্ষপঞ্জির ইতিহাস:

বাংলা সনের ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বহুকাল আগে থেকেই সৌর বছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, কেরালা, মনিপুর, নেপাল ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালিত হতো।

অন্যদিকে আবার বহু ঐতিহাসিক মনে করেন যে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার পরিমার্জন এর মাধ্যমে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা কে একটি সুষ্ঠু রূপ দেওয়ার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর সৌর পঞ্জিকা এবং হিজরি সনের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। কিন্তু বহু ঐতিহাসিক আবার এই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে হিন্দু ঐতিহ্যের বিক্রমী দিনপঞ্জীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করেন।

একথা সত্য যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে আকবরের শাসনকালের বহু আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জিকা এবং নববর্ষ উদযাপনের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সেজন্য আকবরকে বাংলা বর্ষপঞ্জির উদ্ভাবক বলে ধরে নেওয়া যুক্তিসম্মত হবে না। আধুনিক গবেষণার ফলে মনে করা হয় গুপ্তযুগীয় বঙ্গসম্রাট শশাঙ্কের শাসনকালেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়। 

 

পয়লা বৈশাখের বর্ণময় চালচিত্র:

 বাংলা নববর্ষের কথা বলতেই সর্বপ্রথম যে দিনটির কথা আমাদের মনে আসে তা হল পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। এই দিনে দেশ ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ তো বটেই তার সাথে ত্রিপুরা এবং আসাম রাজ্যের কিছু অংশেও বাংলা নববর্ষ মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়।

সাধারণভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল বাংলাদেশে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। বাঙালি এই সময়ে মেতে ওঠে নানা প্রকার উৎসবে। হালখাতা, বিভিন্ন শোভাযাত্রা, নানা ধরনের মেলা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয়। একে অপরকে শুভ নববর্ষ অভিবাদন জানিয়ে সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে বাঙালি বছর শুরু করে। 


নববর্ষে বাঙালির মনন ও সংস্কৃতি:

নববর্ষ প্রতিটি বাঙালির জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনটিতে বাঙালি পৃথিবীর যে কোণেই থাকুক সে তার জাতীয় ঐতিহ্য উদযাপনে মেতে ওঠে। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের বাঙ্গালীদের মধ্যে কিছু বিশেষ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন এই দিনে বাঙালি পুরুষেরা সাধারনত পাঞ্জাবি ও ধুতি এবং মহিলারা নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়িতে সেজে ওঠে।

তাছাড়া এই দিনে বাঙালি ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ বিভিন্ন রকমের ভাজা খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশ এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে মহা আনন্দ সহকারে উদযাপন করে। চারিদিকে পরম আনন্দের পরিবেশে বিভিন্ন মেলা ও উৎসব বাঙালি জাতির মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালি জাতির কাছে এই দিনটি নিজেদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।



বৈশাখী মেলা:

বাংলা লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে বাংলার বিভিন্ন উৎসব। সেই সকল উৎসবের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত বৈশাখী মেলা অন্যতম একটি। বাংলাদেশের নগরায়নের পরিবেশেও এখনো এই মেলা আয়োজিত হয়।

বিভিন্ন গ্রাম থেকে শিল্পীরা তাদের আঞ্চলিক শিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য এই মেলায় নিয়ে আসেন। বাংলার গ্রামীণ পটচিত্র, তথা বিভিন্ন লোকগান, লোকনৃত্য ইত্যাদি এই মেলাতে স্বকীয় মর্যাদা লাভ করে। নববর্ষের আনন্দ উদযাপনের মাধ্যমে বাংলার হারিয়ে যেতে বসা আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে মর্যাদা দান এবং পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস এই মেলার মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায়।


হালখাতা:

বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আলোচনায় বাঙালির হালখাতা পালনের কথাও উল্লেখ করা বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয়। নববর্ষের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির উন্মাদনা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবটির তাৎপর্য হলো বর্ষবরণ-এর শুরুতে ব্যবসায়িক হিসাবগত খাতার হাল-হকিকত যাচাই করে নেওয়া।

তবে এই উৎসবটি সকল ব্যবসায়ী মহলেই পরম রসনার সঙ্গে পালন করা হয়। সকল আমন্ত্রিত ক্রেতাকে করানো হয় মিষ্টিমুখ। ক্রেতারাও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কাছে নিজেদের ধার বাকি মিটিয়ে পরস্পর এক শুভ বন্ধনে আবদ্ধ    হয়।

ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গেও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। যদিও গ্রাম বাংলার চরিত্র মূলত দুই বাংলাতেই একরকম, তবে উৎসবগুলির চরিত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে থাকে।

যেমন পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় চড়কের মেলা, লোকগানের আসর, বাউল মেলা ইত্যাদি। আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান কলকাতায় নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব। তাছাড়া নববর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখের আগে থেকেই বাজারে চলতে থাকে চৈত্র সেল। 


আদিবাসীদের নববর্ষ:

সাধারণ বাঙালিদের পাশাপাশি উভয় বাংলা সংলগ্ন বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যেও বাংলা নববর্ষ পালনের প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত রয়েছে। নববর্ষের সূচনালগ্নে এই সকল আদিবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উদযাপন করে থাকে।

প্রান্তিক অঞ্চলের এই সকল নৃগোষ্ঠী গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছোটনাগপুর, পুরুলিয়া, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি গুলির নববর্ষ উদযাপনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


নববর্ষ উদযাপনের  তাৎপর্য:

বাঙালির নববর্ষ উদযাপনকে স্বাভাবিক আপাতদৃষ্টিতে অগণিত উৎসবের একটি সুষ্ঠু সমাহার বলে মনে হলেও বাঙালির জীবনে নববর্ষ উদযাপনের সার্বিক গুরুত্ব অপরিসীম। সমগ্র একটি বছর ধরে মানুষের জীবনে যে মানসিক ক্লান্তি, গ্লানি ও হতাশা জন্ম নেয় সেগুলি থেকে মুক্তির পথ রচনাতেই উৎসবের সার্থকতা। বাঙালির নববর্ষ উদযাপন এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নয়।


বিভিন্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে নববর্ষ পালন করে বাঙালি পুরনো বছরের সকল ক্লেদ, গ্লানি এবং জীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে প্রকৃতপক্ষে নতুন জীবনের আশ্বাসকেই বরণ করে নেয়। তাছাড়া নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে সকল বাঙালির মধ্যে গড়ে ওঠে এক অপূর্ব স্বাজাত্যবোধ, বেঁচে থাকে বাঙালিয়ানা। বিভিন্ন উৎসবের পালনের মধ্যে দিয়ে বাংলার অগণিত মূল্যবান লোকসংস্কৃতি বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায়। পৃথিবীজুড়ে সকল বাঙ্গালীর মধ্যে ঐক্যগত মেলবন্ধনের সেতু রচিত হয়।



আধুনিক নগরজীবনে নববর্ষ:

বর্তমান যুগে বাইরে থেকে আমদানিকৃত বিদেশী সংস্কৃতির আধিপত্যজনিত বাড়াবাড়িতে বাংলা নিজস্ব সংস্কৃতি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। বাঙালির জাতীয় সত্তার এই সংকটকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে আজকাল বিভিন্ন স্থানে বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের মধ্যেও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা গেছে।

এই অপসংস্কৃতি থেকে বাঙালির স্বাজাত্যবোধ এবং নিজস্ব জাতীয় চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অনতিবিলম্বে আত্মসংস্কৃতির প্রতি যত্নবান হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বর্তমান নগরজীবনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা দ্বারা আয়োজিত সাংস্কৃতিক উৎসব, মিলন মেলা, গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা প্রভৃতি উদ্যোগের কথা উল্লেখ করতেই হয়। 


ওপার বাংলার ( বাংলাদেশ) বর্ণময় নববর্ষ:    এপার বাংলার মতোই ওপার বাংলায়  উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে  পালিত হয় নববর্ষ। বাংলাদেশের ৬৪  টি জেলায় নববর্ষ উদযাপিত হয়। কলকাতার মতোই  ঢাকা শহরে নানান ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মেতে ওঠে কোটি  কোটি  বাঙালি। গোটা বিশ্ব  তাকিয়ে থাকে।  বাংলাদেশের  নাগরিক  পহেলা বৈশাখ মানেই ঢাকার রমনার বটমূলে বর্ষবন্দনা, রমনা পার্ক,মোহরাওয়াদী উদ্যান,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকেশ্বরী মন্দির, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরসহ মহানগর জুড়ে নানান মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে  হাজার হাজার নারী--পুরুষের  অংশগ্রহণে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা ' অর্থাৎ বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল। ঢাকা  শহরের বাইরে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা, স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন ধরনের  প্রতিষ্ঠানেও পহেলা  বৈশাখে অনুরূপ শোভাযাত্রা, মেলা ও  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।  নদীমাতৃক  বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়  নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।বর্তমানে  ঢাকার হাতিরঝিলেও পহেলা বৈশাখে  অনুরূপ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।মহাধুমধামের সঙ্গে হালখাতা অনুষ্ঠান করেন  ব্যবসায়ীরা। পুরাতন  ঢাকায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা  হালখাতা ও শাঁখা  শিল্পীরা হালখাতা অনুষ্ঠানে  সমবেত হয়ে উৎসব  পালন করে আসছে। বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের  বিশেষত্ব হলো  ইলিশোৎসব।বর্ষবরণে আনন্দ আরো বাড়িয়ে দেয়  নতুন  পোশাক, ইলিশ, রসগোল্লা, খই,মুড়ি  আর বাতাসা।ঘরে ঘরে ইলিশোৎসব। ইলিশের  নানান  পদের আয়োজন। পহেলা বৈশাখ ঘিরে ২৪ঘন্টার টিভি চ্যানেল গুলো দেশের বৃহৎ ইলিশের আড়ৎ ও বাজার গুলো  থেকে সরাসরি লাইভ নিউজ ব্রডকাস্ট করে  জানিয়ে দেয় ইলিশের  বাজার দর।মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষের  পাতে ইলিশের অস্তিত্ব  লক্ষ্য করা যায়।  ঢাকার  পহেলা বৈশাখের  মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু  সাংস্কৃতিক  সংগঠন  ছায়ানটের বর্ণময়  সঙ্গীতানুষ্ঠানের  মাধ্যমে  নতুন  বছরের  সূর্যকে আহ্বান। এছাড়া  মঙ্গল  শোভাযাত্রায় শহর  পরিক্রমায়   অংশগ্রহণ করে  হাজার হাজার  সুশীল সমাজ।  বাংলাদেশের  বিভিন্ন  উপজেলায়  বিভিন্ন  উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায়  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ  নিজস্ব বিশ্বাস প্রসূত  পহেলা বৈশাখ  পালন করে আসছে। আট থেকে আশির মানুষ সামিল হয় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। পহেলা বৈশাখ     দুই বাঙলার বাঙালির নিজস্ব  উৎসবে পরিণত হয়  স্বদেশ  চেতনার  হাত ধরেই। পহেলা বৈশাখ  জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির  হৃদয়ের  উৎসব হয়ে  উঠল। দুই বাংলার লক্ষ লক্ষ ঐতিহ্যবাহী  বাঙালি   খাবারের  সমারোহ নিয়ে  জাতি--ধর্ম-বর্ণ  নির্বিশেষে  সব সম্প্রদায়ের মানুষজন  মেতে ওঠে চিরায়ত এই উৎসবের দিনে।  বাঙালিয়ানার  এই দিনে স্পন্দিত হয় পুরো  বাংলা, পুরো বাঙালি জাতি। বিভিন্ন ধর্মের,বর্ণের,বয়সের মানুষ এক পংক্তিতে দাঁড়িয়ে একাত্মতাঅনুভব করেন। সমস্ত ধরনের  সংকীর্ণতা র উধ্বে উঠে  ,সব সংস্কারের জাল ছিন্ন করে সবাইকে  একসূত্রে  গেঁথে  পহেলা বৈশাখ কাছে  টেনে নেয়।  সমাজব্যাপী সৃষ্টি করে ঐক্যানুভৃতি ও    প্রীতিময়তার অমল বন্ধন।


শেষ কথা  :

বাংলা নববর্ষ হল বাঙালির বাঙালিত্বকে উদযাপন করার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির মধ্যে যাতে কোনোভাবেই অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি স্তরে সকল বাঙালিকে সচেতন হতে হবে।

নববর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির বাঙালিত্ব বিশ্বায়িত হোক, বাঙালি সংস্কৃতি মর্যাদা পাক বিশ্বের দরবারে, আধুনিক ভোগবিলাসমূলক জীবন দর্শন ত্যাগ করে আপন আত্মা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির দিকে বাঙালি যত্নবান হয়ে উঠুক এটুকুই বাঞ্ছনীয়। নববর্ষে বাঙালিত্ব এবং বাঙালি সংস্কৃতির পবিত্র উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবনের সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়ে নতুন বছর ভরে উঠুক নতুন জীবনের আশার আলোয়-

“অসতো মা সৎ গময়, 

তমসো মা জ্যোতির্গময়, 

মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়, 

ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।। ওঁ শান্তিঃ।।”  

 


বাঁকুুুড়া,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ