সৈকতের মনটা বিশেষ ভালো নেই। সৈকত, পারমিতার প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই ভেবেছিল সে যেমন পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে তেমনিই পারমিতাও । এই যে এখন, মনটা মেঘলা আকাশের মত তবু এখনও পারমিতার ভাবনায় সৈকত নিমগ্ন। পারমিতাকে নিয়ে ভাবতে পারার শুরুটা পেলেই সৈকত রাজা হয়ে যায়।
আচমকা পরিচয় । প্রথম দেখাতেই সৈকত সমুদ্রের গহীন ঢেউয়ে তলিয়ে যায়। একসময় নিজেকে আবিস্কার করে পারমিতা নামী মেয়েটির কৃষ্ণ-কালো গভীর চোখে। পারমিতাকে দেখার ইচ্ছেটা সময়-অসময় মানে না। প্রতিটি মুহূর্তকে সুসময় মনে করে সৈকত। অথচ সেই যে তিনজন সারাদিন একসাথে কাটিয়েছিল, তারপর পারমিতার আর পাত্তা নেই। পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। সৈকতের মনটা কেমন যেন চঞ্চলা হরিনীর মতো উদভ্রান্ত হয়ে আছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পারমিতার খোঁজে ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়েছে। এদিক-সেদিক অনেক খোঁজাখুঁজি। সবই অবশ্য মনে মনে। মনের মধ্যে এক অসহ্য যন্ত্রণার আগ্নেয়গিরি।
এদিকে আবার রুচিরাকেও খুঁজে নাগাল পাচ্ছে না সৈকত। বিমর্ষচিত্তে সৈকত লাইব্রেরি বারান্দায় বসে আছে। হাতে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ছে। দৃষ্টি নিঃসীম আনমনা। থেকে থেকে সিগারেটে দিচ্ছে লম্বা টান। আবার মনে মনে হেঁটে চলে যাওয়া লোকজনের ভীড়ে পারমিতাকে খুুঁজছে সৈকতের দুটি অস্থির চোখ। আশেপাশে সুখের অনুরণনকে বাতাসে ছড়াচ্ছে অজস্র সুখের নিঃশ্বাস। অথচ কোনকিছুই সৈকতকে স্পর্শ করছে না। চোখের জলসায় শুধু পারমিতার অবাধ বিচরণ। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে সৈকতকে দেখতে পেল রুচিরা। কাউন্টার থেকে ব্যাগটা তুলে নিল। এগিয়ে গিয়ে সৈকতের পাশে বসল কোন কথা না বলে। সৈকত টের পায় নি; গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। রুচিরা ইচ্ছে করেই অস্তিত্বকে জানান দিল গলা-খাকাড়ি দিয়ে। সৈকতের ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে। তারপর ভাবলেশহীন জিজ্ঞাসা- কখন এলেন।
অনেকক্ষণ! অথচ তুমি একটুও টের পাওনি। এত গভীর হয়ে কী ভাবছো?- বলতে বলতে রুচিরা সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না, এমনি। নির্দিষ্ট তেমন কিছুই না।- সৈকতের কণ্ঠে পাশ কাটানোর প্রয়াস।
রুচিরা বুঝতে পেরে কথার মোড় অন্যদিকে নিয়ে যায়, বলে- তারপর, এই ক’দিন তোমার যে দেখা পেলাম না?
সৈকত একটু আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে- আমারওতো একই প্রশ্ন!
রুচিরার জবাব- যদিও আমি কিছুটা ব্যস্ত ছিলাম তবুও তোমাকে মনে মনে অনেক খুঁজেছি।
হলে গেলেই পারতেন।- সৈকত বশে অভিমান ভরা কন্ঠে বলল।
হলে যেতে আলসেমি ধরে যায়। তাছাড়া ব্যতিক্রম চত্বরে এসে খোঁজ নিয়েছিলাম। যাক তারপর বল তোমার খবর কি?
এই চলে যাচ্ছে।- এই বলে সৈকত প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
রুচিরা বলে আমার তো মনে হচ্ছে তুমি বেশ চিন্তিত আছ।
কথাগুলো শুনে সৈকত ভাবল হয়তো রুচিদি সৈকতের মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে। তাই খুবই চঞ্চলচিত্তে সৈকত জানতে চাইলো- পারমিতারও ক’দিন ধরে দেখা পাচ্ছি না।
গত পরশু আমার সাথে দেখা হয়ে ছিল। গতকাল নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এটুকু বলে রুচিরা চুপচাপ বসে থাকে। সৈকত তাকিয়ে আছে রুচিরার দিকে। রুচিরা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার সৈকতের দিকে তাকাল। তারপর বলল গতকাল চাকরিতে জয়েন করে এলাম।
সাথে সাথে সৈকত দু’হাত জোড় করে দুঃখিত কণ্ঠে বলল ভুল হয়ে গেছে রুচিদি। আই অ্যাম অ্যাক্সট্রিমলি সরি!
না, না আমি তেমন কিছু মনে করিনি। রুচিরা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। তারপর কিছুটা আবেগঘন কণ্ঠে বলল তবে মনে মনে তোমাকে আশা করেছিলাম।
পড়ার পাশাপাশি চাকরি চালিয়ে যেতে পারবেন তো? এই বলে সৈকত উত্তরের প্রত্যাশায় তাকিয়ে রইল।
ওহো! বলতেই ভুলে গিয়েছি, পার্টটাম চাকরি! বিকেলে যেতে হবে। অতএব কোন সমস্যা হবে না।
তাহলে খুব ভালো হবে।
খুব ভালো হবে, কথাটা রুচিরার ভেতর কেঁপে উঠল। কিন্তু বাস্তবে তা একটুও প্রকাশ করল না। স্বাভাবিকভাবেই বলল চল, পারমিতাকে একটু খুঁজে আসি।
দু’জন ওঠে। ব্যতিক্রম চত্বর পেরিয়ে ওরা আর্টস বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে চলল। কিছুদূর এগোতেই পারমিতার রুমমেটের সাথে দেখা হয়ে গেল। রুমমেটের কাছে জানতে পেল; গতকাল বিকেলে দিদির বাসায় চলে গেছে পারমিতা। কারণ হঠাৎ করে শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল।
সৈকত রুচিরাকে জিজ্ঞেস করে রুচিদি, আপনার কাছে পারমিতার ফোন নম্বর আছে?
আছে।এই বলে পার্স থেকে ছোট নোটবুকটা বের করে খুঁজে বের করে সৈকতকে পারমিতার ফোন নম্বর দেয়।
তাহলে ফোন করে একবার খোঁজ নেয়া যায়, কি বলেন?
রুচিরা অল্পক্ষণ যেন ভাবল। তারপর বলল চল, সরাসরি চলে যাই। পারমিতার দিদির সাথেও দেখাটা করে আসি।
সৈকত এতটুকু আশা করে নি। তাই বাসায় যাবার প্রস্তাবটা শোনামাত্রই উৎফুল্লচিত্তে বলল হ্যাঁ, চলুন। সরাসরি গিয়ে দেখে এলেই ভালো হয়।
তাহলে চল, এখনই যাওয়া যাক।
সামনের দোকানটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে সৈকত আগুন ধরাল। কাছে আসতেই রুচিরা বলল সৈকত, তুমি কিন্তু সিগারেটের মাত্রা ক্রমশ বাড়িয়ে যাচ্ছ। এটা কোন ভাল লক্ষণ নয়।
দু’কানে হাত ছুঁয়ে সৈকত বলল ‘সরি রুচিদি, কমাতে চেষ্টা করবো।’ কথা বলার সাথে সাথে সারা মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ল দুষ্টুমি ভরা হাসি।
সৈকতের হাসিতে রুচিরার হালকা শাসন মিলিয়ে গেল। তারপর আবার বলল ‘ঠিক আছে, এখন একটা রিকশা নাও।
সৈকত এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করল। চেপে বসল দু’জন। রিকশা চলতে শুরু করল। নিউ মার্কেট ওভার ব্রিজের কাছে রিকশা থামিয়ে সৈকত নেমে গেল। কিছু ফল কিনে নিয়ে ফিরে এল। রিকশা আবার এগিয়ে চলল। রিকশা যতই এগোচ্ছ সৈকত ততই অজানা আমেজের এক বিমুগ্ধ শিহরণে আলোড়িত হচ্ছে। বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা ডুবে ডুবে সৈকত এগিয়ে চলছে। পথে সৈকত এবং রুচিরা খুব কমই কথা বলেছে।
*
কলিংবেল টিপতেই পারমিতার দিদি এসে দরজা খুললেন। নমস্কারটুকু নিয়েই দিদি সরে দাঁড়ালেন। রুচিরা ও সৈকত ড্রয়িং রুমে এসে বসল। দিদি সৈকতের দিকে একপলক তাকিয়েই রুচিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রুচিরা বুঝতে পেরে সৈকতকে দিদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
সৈকত দাঁড়িয়ে দিদিকে নমস্কার জানাল। নমস্কার নিয়ে দিদি বললেন- তোমরা বসো। আমি আসছি।
রুচিরা বলল একটু আগেই খবর পেলাম পারমিতা অসুস্থ।
এখন একটু ভালো আছে।- এই বলে দিদি ভেতর ঘরে পা বাড়াল। পেছন গেল রুচিরা। যাবার আগে রুচিরা সৈকতকে বলল- তুমি বস। আমি একটু দেখে আসছি।
মিনিট দুয়েক পরেই ফিরে এসে রুচিরা সৈকতকে ভেতর ঘরে নিয়ে গেল।
পারমিতা ডান কাত হয়ে শুয়ে আছে। রুচিরা এগিয়ে গিয়ে পারমিতার কোলের কাছে বিছানায় বসল। সৈকত ঘরে ঢুকেই লজ্জায় একটু যেন গুটিয়ে গেল। সম্মোহিতের মত ধীরপদে এগিয়ে গেল। দিদি কাজের মেয়েটাকে ডেকে বলল এই ঘরে একটা চেয়ার দিয়ে যায়।
সৈকত পারমিতার কাছকাছি হয়ে জিজ্ঞ্যস করল-এখন কেমন আছ, পারমিতা?
আড়ষ্টকণ্ঠে পারমিতা বলল এখন অনেকটা ভাল।
রুচিরার ভালোবাসার হাতটুকু পারমিতার কপাল থেকে ফিরে এল। তারপর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল চিন্তা করো না, ভাই। ঠিক হয়ে যাবে।
পারমিতা জবাবে কোন কথা বলে না। শুধু শব্দহীন হাসি হাসল। সৈকত পারমিতার চোখে চোখ রাখল। পলকহীন মুহূর্ত। নির্বাক সময়ের কিছুক্ষণ যাত্রা। পারমিতার চোখ যেন সৈকতকে কাছে ডাকছে। সৈকত একটু আড়ষ্ট হয়ে যায়। তারপর কাছাকাছি এগিয়ে আসে। তারপর পারমিতার কপালে একটা হাত রাখল। হাতটা ভেতরে ভেতরে অসম্ভব রকম কাঁপছে। তাপ দেখে হাত সরিয়ে নিয়ে এসে বলে- ঔষধ ঠিকমত খাচ্ছো তো ?
মাথা কাত করে হ্যাঁ বলে পারমিতা । অবশ্য ‘হ্যাঁ-এর বেশির ভাগ জবাবই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে চোখের এক জ্যোতির্ময় কারুকার্যে । রেখে যাওয়া চেয়ারটা টেনে সৈকত বসে। এই ফাঁকে দিদি অন্য ঘরে গেলেন, বলে গেলেন, তোমরা গল্প কর।
পারমিতা জড়ানো কণ্ঠে বলে রুচিদি আপনি নিশ্চয়ই চাকরিতে জয়েন করেছেন?
হ্যাঁ ভাই, গতকাল জয়েন করলাম।- হাসতে হাসতে রুচিরা জবাব দেয়।
প্রথমদিনের অনুভূতিটা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর, তাই না রুচিদি?- এই বলে পারমিতা রুচিরার দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।
সত্যি খুবই ভালো একটা দিন গেল গতকাল। কথার মধ্যে রুচিরার সবটুকু সুখ ছড়িয়ে পড়ল।
রুচিদি আপনি বেতন পেলেই আমাদের চাইনিজ খাওয়াবেন কিন্তু।- সৈকত রুচিরাকে বলে।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমরা ছাড়া ক্যাম্পাসে আমার আর কে আছে? রুচিরা বেশ উৎফুল্লচিত্তেই বলে কথাগুলো।
নাস্তার ট্রে হাতে কাজের মেয়েটা এলো। পেছন পেছন এলো দিদি। ওদের সাথে দিদিকেও দু’এক টুকরা আপেল এবং মিষ্টিও খেতে হল। রুচিরা নিজ হাতে তুলে পারমিতাকে খাইয়ে দিল।
চা-পর্ব শেষ করে রুচিরা ঘড়ির দিকে তাকাল। একটা বেজে কুড়ি মিনিট। কিন্তু কিছু বলার আগেই দিদি বললেন ভাই ঘড়ি দেখে কোন লাভ হবে না। দুপুরে তোমরা খেয়ে যাবে। রুচিরার সাথে সাথে সৈকতও ‘না-না’ করছিল।
দিদি হালকা আদুরে ধমক দিয়ে বললেন তোমরা কোন কথা বলো না।
রুচিরা বলে দিদি, আমাকে অফিসে যেতে হবে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল এমনভাব নিয়ে দিদি বললেন সরি, আই অ্যাম রিয়্যালি সরি। তোমার চাকরির কথা পারমিতা বলেছিল। অথচ তোমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলাম না। একটুক্ষন থেমে দিদি আবার বললেন ভালো, খুব ভালো। মেয়েরা আজকাল অনেক সাহসী হচ্ছে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। তোমার অফিস ক’টায়?
বিকেল চারটা হতে সন্ধ্যা আটটা নাগাদ।
তাহলে তো খুবই ভালো হল। দুপুরে এখানে খাবে। বিশ্রাম নেবে। তারপর অফিস যাবে এখান থেকেই।
রুচিরা আমতা আমতা করছিল।
দিদি রুচিরাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তোমাকে আমি এত সাধতে পারবো না। বসে বসে গল্প কর, আমি আসছি আর কোনরকম জবাবের জন্য অপেক্ষা করলেন না দিদি।
0 মন্তব্যসমূহ