সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

বেঙ্গলী মিডিয়াম ভার্সেস ইংলিশ মিডিয়াম : পর্ব- ০৫


ডঃ গৌতম সরকার

 

যাদবপুরে প্রথম বছর খুব অসুবিধার মধ্যে কেটেছে ; কপালে হস্টেল জোটেনি, কবে জুটবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ প্রথম কয়েক সপ্তাহ বাড়ি থেকে যাতায়াত করে ক্লাস করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিন ঘন্টা যাওয়া আবার তিন ঘন্টা ফেরা ব্যাপারটা একটু বেশি কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো ; অবশেষে বাড়ির পরামর্শে এক সোমবার বিকেলে ক্লাস শেষ করে ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি এক নিকট আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে উঠলাম৷ দুয়েকদিন পরই সেই নতুন আস্তানা অন্য সুরে বাজতে লাগলো ; প্রথমে একটু আড়াল–আবডাল ছিল, তারপর প্রত্যক্ষভাবেই অপছন্দ -অসন্তোষের খন্ড খন্ড শব্দ, বাক্যাংশ কানে আসতে লাগলো৷ আমার ওই পরম আত্মীয় রাস্তা চলতি মানুষদের দাঁড় করিয়ে তাদের হালহকিকত জানার নামে আমার উপস্থিতিতেই ইদানিং নিজের সংসার খরচ কিভাবে বেড়ে চলেছে সেই নিয়ে আক্ষেপ করতে শুরু করলেন৷ বুঝে গেলাম এখানে আমার আর বিশেষ সুবিধা হবেনা৷ সোমবার এসে শুক্রবার বেরিয়ে এলাম, আবার শুরু হল ডেলি প্যাসেঞ্জারি৷ যার ফলশ্রুতি ক্লাস কামাই, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম এভাবে চললে জীবনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অনার্স গ্র্যাজুয়েট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে৷ ওইটুকু বয়সেই বারংবার অভিজ্ঞতা হয়েছিল - অনেকের জীবনে রক্তের আত্মীয়দের চেয়ে অনাত্মীয় বন্ধুবান্ধব,পাড়া-প্রতিবেশী অনেক বেশি আপনার হয়৷ তার প্রমাণ আরেকবার পেলাম৷ আমার সঙ্গে একই সাথে একই ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা সুব্রত৷ ও ও তখনও হস্টেল পায়নি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত নিউ পি.জি হস্টেলে এক সিনিয়র দাদার গেস্ট হিসেবে থাকতো, আমার অবস্থা দেখে আমায় হস্টেলে নিয়ে গেল আর প্রথম রাত নিজের গেস্ট ( অর্থাৎ গেস্টের গেস্ট ) হিসেবে রাখলো৷ কিন্তু গেস্টের গেস্ট আইনত বৈধ নয়, তাই পরের দিন থেকে ওই হস্টেলের সিনিয়র দাদারা (অষ্টদা, কিংকরদা, মৃণালদা ) আমাকে দুদিন - চারদিন করে নিজেদের গেস্ট হিসেবে রাখতে শুরু করলো৷  এখানে ওরা কিন্তু একবারও জিজ্ঞাসা করেনি আমি কোন মিডিয়ামে পড়াশোনা করেছি, কারণ তখন এই মানবিক মূল্যবোধগুলো একদম ভিতর থেকে নিঃসারিত হত তার জন্য ভন্ডামির কোনো মুখোশ পড়তে হত না৷

     তবে আমার কপালে এক বছরের মধ্যে হস্টেলের শিকে ছিঁড়ল, ততদিনে অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে, অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়েছে আর রেজাল্ট হয়েছে শোচনীয়৷ বেশ ভয় পেয়ে গেলাম, একদিকে এই কোলকাতা শহরের সাথে প্রতি মুহূর্তে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ তার ওপর ভয়ঙ্কর সিলেবাসের পাহাড় প্রমাণ বোঝা ( ৯০০ মার্কসের পরীক্ষা একসাথে দিতে হত, পার্ট ১, পার্ট ২-র বিভাজনই ছিলনা, সেমিস্টার তো দুরস্ত )৷ কিন্তু পরের ওই একবছর আমার জীবনের সত্যিই এক মনে রাখার মতো সময়, কোলকাতায় একটা সাময়িক হলেও আশ্রয় জুটলো, বন্ধু বান্ধবদের অনেক কাছাকাছি আসার সুযোগ হল, সবচেয়ে বড়কথা কোলকাতার ইঁট -কাঠ -মাটির সাথে সখ্যতা হল, আস্তে আস্তে কল্লোলিনী তিলেোত্তমাকে ভালবেসে ফেললাম৷ এই শহর একবারও আমার কাছে জানতে চায়নি আমি কোন মিড়িয়ামের !!! কারণ তখন ভালোবাসা ছিল শর্তবিহীন, আত্মীয়তা ছিল অন্তরের, সেই ভালোবাসায় জারানো আত্মীয় হওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতার মরুভূমি পেরোতে হতনা৷ 

     আমাদের ওই আটজন বন্ধুর দলটা ইতিমধ্যে পাকাপোক্ত হয়ে উঠলো ; তখন আমাদের প্রথম চারটে ক্লাসের পর একটা টিফিন ব্রেক থাকত৷ আমরা সাতজন মিলে নীচে নেমে নাসিরদার চায়ের দোকানে গিয়ে বসতাম, ওদিক থেকে ডেইজি এসে জুটত৷ চা-সিগারেটের ধোঁয়ায় আড্ডা জমে উঠত, কিছুদিন পর এমন হল নাসিরদা আমাদের চা খাইয়ে কিছুক্ষণের জন্য দোকান ছেড়ে বাড়ি চলে যেত আর ওই সময়ে লোপা দোকান আলো করে বসে বিড়ি -সিগারেট বিক্রি করত, কিছুদিন পর নাসিরদার রেভিনিউ বাড়ানোর জন্য লোপা পান সাজাও শিখে নিয়েছিল৷ আজ সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে, কেমন যেন স্মৃতিমেদুর হে পড়ি৷ এই সব বন্ধুদের কাছে আমি আলাদা আলাদা ভাবে কৃতজ্ঞ, এরা আমার চরিত্র গঠনে, আমাকে এই শহরের একজন হয়ে উঠতে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে৷ কোথাও কখনো একবারও মনে হয়নি ওরা আমার মূলকে চিনতে চেয়েছে, আমাকে একদম আমার মতো করে গ্রহণ করে এতো বেশি ভালোবাসা দিয়েছে যার ফলে আমার অগোচরে এই শহর তার আদরের আঁচল বিছিয়ে কখন যেন আমাকে একান্ত আপনজন করে তুলেছিল৷

   শেষ একবছর কিন্তু বেশ পড়াশোনা করার দরকার হয়ে পড়ল, ইতিমধ্যে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি, আমি আবার খুব বেশি ক্লাস করতাম না কিন্তু আজকের স্টুডেন্টসদের মতো পরমুখাপেক্ষিও ছিলাম না৷ এতটুকু জাহির করছিনা - বিষয়টা একটু বুঝতাম ; মনে আছে ক্লাসে যাইনি কিন্তু স্যারের পড়ানোর রেফারেন্স জেরক্স হয়ে আমার কাছে চলে আসত৷ সেটা বারবার পড়ে অন্তর্নিহিত অর্থটা বুঝে নিতাম তারপর নিজের মতো করে নিজের ভাষায় নোটস তৈরী করতাম এবং সেটা বন্ধুদের মধ্যে বিতরিত হত ; আবার অন্যদিকে অন্য বন্ধুদের বানানো নোটসও একই ভাবে আমাদের কাছে আসত৷ এই পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া এত স্বতস্ফুর্ত ভাবে হত, অতীতের বাংলা-ইংরেজি মিডিয়াম কখনো কোনোভাবেই এই পারস্পরিক আদান-প্রদানে বাধা সৃষ্টি করতোনা৷ সোনালী খুব ভালো নোটস বানাতো, কারণটা খুব স্বাভাবিক – যেমন নিয়মিত ক্লাস করত তেমনি ইংরেজিটা অসম্ভব ভালো লিখত, সেই সোনালীও আমার নোটসের জন্য অপেক্ষা করত৷ সেইদিন থেকে আমি যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করলাম সেটাই আজকে আমি যেটুকু আমি, সেটুকু আমির ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করতে সাহায্য করেছিল৷ আর এর জন্যে যে সমস্ত বন্ধুদের অবদান আমি কখনো ভুলতে পারবো না তারা কিন্তু বেশিরভাগই ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছিল৷ 

  আমি যে শুভক্ষণে মায়ের কোলে এসেছিলাম, প্রত্যেক শিশুর মতো আমিও এক গণে জন্মেছিলাম, আর আমি নিশ্চিত সেটা ছিল - বন্ধু গণ ; আমি জানিনা আমার মতো এতো দরদী বন্ধু পাওয়ার সৌভাগ্য কারোর হয়েছে কিনা৷ আমি আমার এই পঞ্চাশোর্দ্ধ জীবনে উথ্থান পতনে সবসময় এক বা একাধিক বন্ধুকে পাশে পেয়েছি আর আশ্চর্য্যজনক ভাবে তারা অধিকাংশই এসেছে ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাক গ্রাউন্ড থেকে৷         

     (চলবে…….)

 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ