সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ছোটগল্প- অবৈধ যুদ্ধ

  

 
 রিটন মোস্তফা

বহুদিন পর দেশে যাচ্ছে দহন। বাবা মারা যাবার দশ মাস পর মাও মরা যান, এর পর আর দেশে যাবার তাগিদ অনুভব করেনি সে। USA একটা ভাল জব পাবার পর থেকে এমনিতেই দেশে খুব কম যেত সে। এখন জব ছেড়ে দেশে আসছে এখানেই একবারে থেকে যাবার জন্য ।

 ট্রেনটা এসে দাঁড়ালো রূপনগর। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তবে তেমন অন্ধকার এখনও হয়নি। গ্রম্য স্টেশন । যাত্রীরা তেমন একটা এখানে নামেনি,ওঠার জন্যেও তেমন কেউ আসেনি। তবে একটা টর্চ হাতে রহিম চাচা কে সে ঠিকই দেখতে পেলো এবং চিনতেও পারলো। এই রহিম চাচাই তাঁদের বাড়ি এবং জমিজমা দেখাশোনা করে বহু বছর ধরে ।

"রহিম চাচা....."

কঙ্কালের মত হাল্কা পাতলা দেহ নিয়ে রহিম চাচা এগিয়ে এল। "দহন বাবা"
জড়িয়ে ধরলেন তিনি দহনকে। কেঁদে ফেললেন আবেগে। বহুদিন বাদে দেখা তাঁদের । এই রহিম চাচাই তাঁকে কোলে পিঠে করে এক সময় বড় করেছে। পড়াশোনা করার জন্য আমেরিকা যাবার আগ পর্যন্ত ।

"হ্যাঁ চাচা! কেমন আছ তুমি?"

"ভালো নাই বাবা,তবে তুমি এসেছো এখন ভাল থাকবো। তোমার বাবা মারা যাবার পর আমি এতদিন সব ঠিকঠাক সামলে রেখেছি। এখন তোমার পালা।"

  রহিম চাচার সাথে হাঁটতে লাগল দহন। বেশ কিছুটা রাস্তা হাঁটতে হবে বাড়ি পর্যন্ত । নিজের গ্রামটাকে কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে দহনের কাছে।

    বাড়ির কাছাকাছি আসতেই একটা ব্যপার দহনকে ধাক্কা দিল। রুগ্ন হাল্কা পাতলা একটা ময়ে চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে বাচ্চা কোলে তাদের দিকেই দৌড়িয়ে আসছে।  পিছনে পিছনে গ্রামের কিছু মানুষ ধাওয়া করছে আর ঢিল ছুড়ছে মেয়েটার দিকে। রহিম চাচা পাগলের মত আমাকে ফেলে ময়েটাকে গিয়ে ধরলো। তাকে আগলে রাখার জন্য জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়ল। হঠাৎ এমন একটি ঘটনায় দহন হতভম্ব হয়ে গেছে। বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে, আর তাঁর এখন কি করা উচিত!

"তোমরা ওকে মেরনা,ওকে মেরনা। ও আর বাহিরে আসবে না । এবারের মত ছেড়ে দাও ওকে।"
তেড়ে আসা গ্রামের লোকজন কে উদ্দেশ্য করে বারবার চিৎকার বলতে লাগলো রহিম চাচা । গ্রামের লোকজন তবুও ঢিল ছুড়ছে। আর সে ঢিলগুলো এখন রহিম চাচাকে আঘাত করছে।

" এই থামেন আপনারা, কি হয়েছে? এভাবে একটা মেয়ে কে মারছেন কেন?"

" কে দহন বাবাজি নাকি? "
মধ্য বয়সী একজন দহনের দিকে এগিয়ে এল।
" তুমি কবে আসলে বাবাজি? "
"আজই, এইমাত্র আসলাম। কিন্তু কি হয়েছে আপনারা এই মেয়ে কে মারছেন কেন?"
" সে আর বলোনা বাবাজি । নোংরা মেয়ে । কার না কার সাথে কি সব করে বেড়ায় । দেখ ওর কোলে বাচ্চা । শুনে দেখ তো ওটা কার? বিয়ে হয়নি অথচ এই মেয়েটি বাচ্চার মা।"

অবাক হল দহন। "মেয়েটি কার?"

রহিম চাচা এবার এগিয়ে এলো। "বাবা, ও নিশা । ঐ যে ছোট বেলায় তুমি যাকে নিয়ে খেলতে? ঐ নিশা। আমার মেয়ে ।"

সন্ধ্যার আঁধো আলোয় ভালো করে নিশাকে চেনার চেষ্টা করলো দহন।

মধ্য বয়সি লোকটা আবার বললোঃ "এই নোংরা মেয়ে কে এখনই গ্রাম ছাড়া করা উচিত। আর তা না হলে আমাদের সন্তানদেরও ক্ষতি হবে। বিচার সালিশে ওকে এক ঘরা করা হয়েছে । ঘর থেকে বড় হতে নিষেধ করা হয়েছে যতদিন না গ্রাম ছাড়ে। তবুও দেখ বাবাজি গ্রাম্য বিচার অমান্য করে বের হয়েছে।"

লোকজন সব বাবা মেয়েকে ঘিরে গালাগালি এবং কেউ কেউ লাথিও মারছে। দহন এগিয়ে গেল। নিশা মাথা নীচু করে আছে বাচ্চা টাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বাচ্চা কান্না করছে। মাও কাঁদছে, তবে নিঃশব্দে আর দহনের দিকে তাকাচ্ছে । যেন বলতে চাইছে সাহায্য করো আমাকে। বাঁচাও!

দহন সবাইকে থামতে বললোঃ "দেখুন ওর ভুল হয়ে গেছে। ও আর বাহিরে আসবে না । আমি কথা দিচ্ছি । আপনারা থামুন।"

"বাবাজি তোমার বাবা এই গ্রামের মাথা ছিলেন। ভালো মানুষও ছিলেন। আমরা তাঁকে সন্মান করতাম । তুমি যখন বলছো, তখন থামছি। তোমাদের বাড়ি জমাজমি দেখা শোনা ওর বাবা করে বলে ওকে ছাড় দিও না । এরকম মেয়ে গ্রামে থাকলে আমাদের মেয়েরাও নষ্ট হবে । ওকে বলো, ঐ অবৈধ বাচ্চাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে।"

"ঠিক আছে চাচা তাই হবে।"

গ্রামের লোকজন একে একে চলে গেলো।
"রহিম চাচা চলো। নিশা কে নিয়ে বাড়ি চলো। তার পর শুনবো কি হয়েছে ।"

নিশার শরীরের ওনেক যায়গায় ঢিল লেগে ফুলে ফুলে আছে। মুখেও লেগেছে । ফুলে আছে। চেনা যাচ্ছে না ।

    নিশা কে বাড়িতে রেখে দহন আর রহিম চাচা নিজের বাড়িতে এল। সাথে আনা জিনিসপত্র রেখে দহন ফ্রেশ হয়ে নিলো। রহিম চাচা ততক্ষণে খাবার রেডি করে ফেলেছে।

ডাইনিং টেবিলে খাবার খেতে খেতে রহিম চাচার কাছে নিশার ব্যপারে সব শুনলো দহন ।

     নিশা শহরের একটা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতো। সে সময় একটা ছেলের সাথে তাঁর সম্পর্ক হয়। বছর ঘুরে যখন নিজের বিশ্বাসের কারণে এবং ভুলে নিশা প্রেগনেন্ট, তখন একদিন সে আবিষ্কার করল যে তার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। কোন ভাবেই আর সেই ছেলেটির সাথে সে যোগাযোগ করতে পারছে না। ফোন বন্ধ । ছেলেটা যে ফ্যাক্টরিতে ম্যনেজারি করতো, সেখানেও তার কোন খোঁজ নেই । নিশা দিশেহারা হয়ে গেলো। দিনের পর দিন ঐ ছেলেটার খোঁজ নিতে লাগলো। সাত দিনের মাথায় সে জানতে পারলো, ছেলেটা পাশের শহরে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে কদিন আগে । লাশ সনাক্ত করতে অসুবিধা হয়েছে চেহারা থেতলে যাবার কারণে এবং সনাক্ত করা যায় এমন কিছু কাছে না পাবার কারণে। আর যখন ছেলেটির পরিবার শনাক্ত করলো তখন অনেক দিন হয়ে গেছে। নিশা জানিয়েছে পরিবারকে সব তারা আর তার ছেলের সম্পর্কের কথা, পেটের সন্তান এর কথা। পরিবার অস্বীকার করেছে সব। আর তাদের ছেলেও নাকি এব্যপারে কখনো পরিবারের কাউকে জানইনি ।

নিশার বাবা রহিম চাচা যখন এসব জানতে পারলো, তখন অনেক দেড়ি হয়ে গেছে। কোন ভাবেই নিশা নিজেও রাজি হচ্ছিল না, আর রহিম চাচাও কোন ডাক্তার কে এই বাচ্চা নষ্ট করাতে রাজি করাতে পারেনি। মেয়েই যখন রাজি না। যতো যাই হোক নিশার কথা হচ্ছে তাঁরা রেজেস্ট্রির মাধ্যমে বিয়ে না করে ভুল করলেও তারা মৌলভি দিয়ে ধর্মীয় ভাবেই বিয়ে করে রেখে ছিল। আর সে কারনেই সে বাচ্চা নষ্ট করবে না। আর ছেলটা তো বেইমানি করেনি। নিশাও তাঁকে খুব ভালোবাসে এখনও।

দহন সব শুনলো। এখানে সান্ত্বনা দেবার কিছু খুঁজে পেল না সে।
"রহিম চাচা, তুমি বাড়ি যাও। কাল সকালে আমি নিশার সাথে কথা বলবো।"

রহিম চাচা বাড়ি চলে গেলো।

পরদিন সকালে দহন রহিম চাচার বাড়িতে গেল। নিশা আর বাচ্চাটাকে দেখল। নিশার চোখ মুখ আঘাতে এখনো ফুলে আছে। খুবই সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। ছেলে। দহন কোলে নিলো ছোট্ট বাচ্চাটাকে। বাচ্চাটা দহনের কোলে খুব লাফালাফি করছে খুশিতে। হাত পা ছুড়ছে আর গলা জড়িয়ে ধরছে।

মথা নীচু করে দড়জায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। লজ্জা পাচ্ছে হয়তো সে।

" শোন নিশা। আমি রহিম চাচার কাছে সব শুনেছি। গতকাল সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজনের অবস্থাও দেখলাম। আর আমি নিজেও বুঝি। মোট কথা তুমি এতদিন একা একা একটা খুব বড় লড়াই করছো। যেটাকে সবাই অবৈধ লড়াই ভাবছে। আমি অনেক ভেবেই বলছি। আমি তোমাকে এ লড়াইয়ে সাহায্য করতে চাই। আর এটার জন্য সহজ রাস্তা হলো বিয়ে । আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, যদি তুমি রাজি থাক।

অবাক এবং হতভম্ব হয়ে গিলো নিশা এবং রহিম চাচা।
" বাবা তুমি কি বলছো এটা?"
"হ্যাঁ রহিম চাচা। লজ্জা এবং সন্মান রক্ষার থেকেও বড় কথা এটা যে, এই বাচ্চাটার তো কোন দোষ নেই এসবের জন্য। কিন্তু এভাবে ও কেন অনিশ্চিত, লজ্জা, অপমানের জীবন পাবে? আর নিশা কে আমি ছোট বেলা থেকে চিনি, ওর সব কথা আমি বিশ্বাস করেছি, কিন্তু গ্রাম সেটা করেনি এবং করবেও না। নিশা এবং আপনি যদি রাজি থাকেন তো গোটা গ্রাম কে যা বোঝানোর আমি বোঝাব। সেটা আমার দায়িত্ব।"

রহিম চাচা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। আর নিশা?  সে স্তব্ধ এবং নির্বাক।

- বিরূপ মন্তব্য করলেও গ্রামের সবাই দল ধরে দহনের বাড়িতে আসছে। অনেক বড় করে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । গ্রামের সবাই আজ দহনের বাড়িতে আমন্ত্রিত। আজ দহন আর নিশার বিয়ে। বাচ্চাটা বাবা পাবে। যেটা ওর ভবিষ্যতে স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য খুবই প্রয়োজন।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ