সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভ্রমণকাহিনী- অপরূপা : পত্রাতুভ্যালি-মুরগুমা ও বাংসা



ডঃসুবীর মণ্ডল 


আজ কবি গুরুর সেই বিখ্যাত কবিতাটির কয়েকটি পঙতি  উপলব্ধি করতে পারলাম,"দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি  ধানের  শিষের উপর/একটি শিশির বিন্দু"।সত্যি  ঝাড়খণ্ড বলতে    বলতে আমরা এতদিন  রাঁচি, জামশেদপুর,গালুডি,ঘাটশিলা,নেতারহাট,ম্যাকলিগঞ্জ,রাজারাপ্পা ,হড্ড্রুফলস, কোয়েল ও সুবর্ণরেখা,দলমা রেঞ্জ, দেওঘর , দশম ফলস,শিমুল তলা, টাটানগরকে  বুঝতাম । কিন্তু পুরুলিয়া জেলার সীমান্ত সংলগ্নে যে এতো সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর শান্ত, নিরিবিলি ,মনোরম  এমন হৃদয়হরণকারী এটি জায়গা রয়েছে  রামগড়ের ' পত্রাতু ভ্যালিতে ' না গেলে সেটা কোনদিন অনুভব করতে পারতাম না। এ-যেন   একটুুুকরো    স্কটল্যাণ্ড , প্রকৃতির অফুরান সৌন্দর্য্যের   স্বর্গ রাজ্য। যেখানে দু'-তিনদিন হারিয়ে যাওয়া যায়।
   আমাদের চায়ের আসরের সান্ধ্যকালীন  আড্ডায় ঠিক  হলো যাওয়ার।লকডাউনের কয়েক দিন     আগে বসন্তের এক কাকভোরে,  ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ শনিবার, একটি বোলারো  গাড়ি নিয়ে খাতড়া শহর থেকে যাত্রা শুরু করলাম। সফর সঙ্গী আমরা ৮জন পাহাড় ও প্রকৃতি  প্রেমিক বন্ধু,ঘোরা যাঁদের  কাছে নেশা ও সখ।  কোলাহল মুুুখর খাতড়া    শহর থেকে সামান্য দূরে আসতেই পথের দুপাশে পেলাম  লাল পলাশের অযাচিত উষ্ণ অর্ভ্যথনা। এ -যেন পলাশের মন মাতাল করা বন্য রূপ। পূর্ব দিকে সূূূূর্যদেব  কাঁচাসোনা রঙ ছড়়িয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে।এক মায়াবি পরিবেশ ।শুধু মুুুুগ্ধতা ।জঙ্গল মহলের মসৃণ  রাস্তা দিয়ে   রাঙা মাটির হৃৃৃদয়়  ছুঁয়ে ৬০কিমি গতিতে গাড়ি চলছে, পুরুলিয়া শহরের অভিমুখে ।দ্রুত  পালটাচ্ছে প্রকৃৃতি। অবশেষে   হাাতিরামপুর, মানবাজার, পুঞ্চা, হয়ে ২ ঘন্টায় পুরুলিয়া শহরে প্রবেশ করলাম। দূরত্ব ৯০কিমি।একটু  চা পানের ক্ষণিক বিরতি।ঘড়ি সময় জানাচ্ছে সকাল ৭টা। বসন্তের ঝকঝকে সকাল। শহরে -গাড়ি-জট তখনও শুরু হয়নি। পুরুলিয়ার শহর সীমানা ছাড়িয়ে ত্রিমুখী রাস্তা।ধানবাদ, বাঁকুড়াও রাঁচি অভিমুখে। রাঁচিগামী পথে গাড়ি চলতে শুরু করল। গাড়িতে বসেই  টিফিন পর্বশেষ করলাম।
 একটু বাদে চাসরোড পেলাম।ঢেউ খেলানো মসৃণ স্বপ্নের রাস্তা।ল্যাণ্ডস্কেপ অনেকটাই মধুপুর-শিমূলতলার যেন কালার ফটোকপি। ডুবুরডি,জয়পুর,বেগুনকোদর,ঝালদা হয়ে,তুলিন ছুঁয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছলাম তুলিনের একেবারে কাছে বাংলা-ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে মুরি জংশনে। সাজানো গোছানো সুন্দর ছোট শহর। পুরুলিয়া থেকে দূরত্ব ৫৮কিমি,সময় লাগল১-৩০মি। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৮টা। প্রথমে দেখা হলো সুবর্ণরেখা নদীর সঙ্গে।ছোটনাগপুর পাহাড়ের হাতছানি আর চোখ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতি। 




ভালোলাগার পরিমাণ অনেকটাই বাড়িয়ে দিল দূষণ মুক্ত নির্মল অনাঘ্রাতা প্রকৃতির মায়াবী রূপ।এখান থেকে সোজা একটি রাস্তা চলে গেছে হাজারিবাগ।আর ডানদিকের পথ বোকারোগামী। আর একটি পথ রামগড় হয়ে  সরাসরি অপরূপা পত্রাতু উপত্যকায়।লোকমুখে জানলাম এখান থেকে রাজারাপ্পার ছিন্নমস্তা মন্দিরের দূরত্ব ৬০কিমি।মনটা কেমন হয়ে গেল,এতকাছে এসেও মা ছিন্নমস্তাকে  দেখতে পাবনা!  মুরি রেলশহর, ,ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলায় অবস্থিত। এখানে একটি ইণ্ডালের কারখানা দেখলাম সবাই।লোহারদাগা থেকে আকরিক এনে এখানে গুঁড়ো করা হয়। চারিদিকে ছোট ছোট টিলা, মেঘের চাদর গায়ে ঢাকা দিয়ে রয়েছে। ইতস্তত জঙ্গল আর দিগন্তের তরঙ্গায়িত নীল পাহাড় শ্রেণি।দু'একটা পাখির ডাক, সুবর্ণরেখার অস্ফূট কলধ্বনি। শীতের পাতা ঝরার রিক্ততা, বসন্তে পলাশ, শিমুল, কুসুমের রক্তিমাভায় রঙিন প্রকৃতি--দুর্দান্ত সব সিল্যুয়েট নিয়ে তুলনাহীন তুলিন ও মুরি। চারিদিকে  ঘুরতে শুরু করলাম।একে- একে সুবর্ণরেখার তীরের সূর্য,শনি, হনুমান,শিব,কালি  মন্দির গুলো দেখলাম। মোহাবিষ্ট হলাম। নীরবে নিভৃতে সুন্দরকে উপভোগ করার মতো জায়গা   কম -ই আছে।মুরির রেললাইনের  কাছে একটি হোটেলে ডিম,ভাত,সব্জি দিয়ে দুপুরের খাওয়া পর্ব সারা হলো।সময় নষ্ট না করে দুপুর ১টার সময় গাড়ি করে যাত্রা শুরু হলো‌। এবার গন্তব্য ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার পত্রাতু ভ্যালি।এখান থেকে দূরত্ব ১১০কিমি।রোড ঝালদা- মুরি- রামগড়--পাত্রাতুভ্যালি। এক স্বপ্নের সফরে চলেছি। পরিকল্পনা ছিল রাত্রে  ওখানকার পত্রাতু লেকের নির্মল প্রকৃতির কাছে রাত্রিবাস করবো , পরের দিন ঝালদা - তুলিনের মনকাড়া বাংসা পাহাড় দেখে মুরগুমাতে রাত্রিবাস করে পরের দিন অযোধ্যা পাহাড় ছুঁয়ে ফিরে আসবো।


 গাড়ি চলতে শুরু করল। পালটে যেতে লাগল প্রকৃতি।এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত রাস্তা দিয়ে চলেছি‌ ছোট ছোট জনপদ অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে চলেছি। শুধু সবুজের সমারোহ। পাহাড়ি পথ যেন স্বপ্নের পথ।পাহাড় আর জঙ্গল একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে।বহু ঘুরেছি কিন্তু এই ধরনের  ভ্রমণ এই প্রথম। এই মুহূর্তে এই উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য খুব বেশি প্রচারের আলোয় আলোকিত হয় নি।তবে তাড়াতাড়ি অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।১৩২৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই স্বপ্নের ভ্যালি ।ঝাড়খণ্ডে ' হিডেন জেমস'নামে পরিচিত।পত্রাতু ভ্যালি রাঁচির উত্তরে রামগড় জেলার ছবির মতো সুন্দর একটি উপত্যকা। ধীরে ধীরে পর্যটকদের কাছে তার রূপের ডালি নিয়ে ধরা দিচ্ছে। উচ্চতার কারণে এখানে সারাবছর মনোরম আবহাওয়া বিরাজ করে। এই উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর লেক ,এর আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ি চলছে, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম  জঙ্গল আর পাহাড়কে জড়িয়ে ধরে একটি রাস্তা ওপরে উঠে এসেছে। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখলাম সবুজ উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য। বেশ কিছু সময়ের জন্য আমরা একটি ভিউ পয়েন্ট-এ  থামলাম ‌ । ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখলাম দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা আর পাহাড়। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড় ঘেরা বিশাল জলাশয়।টলটলে জলে  টইটুম্বুর। সূর্যের আলোতে
 মায়াবী লাগলো। গোটা উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর রাস্তা আমাদের মুগ্ধ করলো।। পুরো পথটাতে প্রকৃতি তার উজাড় করা রূপ ঢেলেদিয়েছে। কখনো পাকদণ্ডী পথের গোলোক ধাঁধায় বেশ কয়েক বার ড্রাইভার পথ ভুল করলো।মনে হলো  অনেক গুলি পাহাড়ি রাস্তা যেন পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়েছে কিন্তু পরে অনুভব করলাম আসলে ওটা একটিই রাস্তা। বেলা ৫টার সময় পৌঁছে গেলাম।সময় লাগলো প্রায় তিন ঘন্টা। একটি অসাধারণ বিনোদন কেন্দ্রের পাশে ও লেকের গাঁ ঘেষে  একটি লজে জিনিসপত্র রেখে আবার বেরিয়ে পড়লাম। আসলে আমরা পত্রাতু ভ্যালির সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। একটু  সামান্য টিফিন সেরে চলে গেলাম লেকের একদম কাছে। সূর্য দেব ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে।ডুবন্ত সূর্যের আলোর ছটায় আর মোহময়ী হয়ে উঠলো পত্রাতু লেক ও উপত্যকা।  সূর্যাস্তের মুখে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।ব্যালকোণি থেকে দেখছি অপরূপা লেককে দু'চোখ দিয়ে। পূর্বদিগন্তের রক্তিমাভায় অপার্থিব শোভারঞ্জিত দৃশ্যাবলীতে বিমুগ্ধ, বিমোহিত হলাম।  রাতের খাবার পর্ব সারলাম। পরের দিন খুব সকালে লেকের নির্মল প্রকৃতির কাছে চলে গেলাম। উন্মুক্ত দিগন্তে পাহাড়গুলি অপরূপ গরিমায় দৃশ্যমান। চোখ-মন ভরে গেল সে স্বর্গীয় দৃশ্যে। সূর্য তখন অনেক উপরে উঠে গেছে। সেই নির্মেঘ সূর্যালোকে সবুজ উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করলো।    পত্রাতু লেক আর সবুজ উপত্যকায় আমরা মজে গেলাম। ভীড় খুব বেশি ছিল না। স্হানীয় মানুষজন,জিপ,গাড়ির ড্রাইভার,আরকিছু  পথভোলা পথিকের ঘোরাঘুরি। অপূর্ব নিরিবিলি শান্ত শান্তির পর্যটন স্হল এই ভ্যালি আর লেক। ছোট্ট পাহাড়ি শহর ছাড়িয়ে সামান্য এগোলেই প্রকৃতির  অবাক করা রমনীয় পরিবেশ।ফুলে,বৃক্ষে, মানুষের হৃদয় ওপড়ানো অমলিন হাসিতে যা পেলাম তার সবটাই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ। প্রকৃতির মহার্ঘ্যদান। দু'হাত দিয়ে নেওয়া। সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।ড্যামের জলে বেশ কিছু জায়গায় চাষাবাদ করে মানুষ বেঁচে আছে।সীমাহীন দারিদ্র্য বিমোচন-এর কোন সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়লো না।এই পর্যটন কেন্দ্র হয়তো ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। সারাদিনের ব্যস্ততায় কখন যেন হাই তোলা সূর্যের সঙ্গে মেঘও তার চুল এলিয়ে দেয় পত্রাতু ভ্যালির পাহাড়ের বুকে । সোনালী আভায় লাজুক মুখ নিয়ে পাহাড়ের ওপর অভিমান করে ঘুমিয়ে পড়ে পত্রাতুর অপরূপা সুন্দরী লেক। প্রকৃতির কোলে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে কাছেপিঠের বেশ কয়েকটি সুন্দর পাহাড়ি জনপদ ঘুরে  আমরা  রওনা দিলাম মুরি শহরের দিকে।১১০কিমি রাস্তা অতিক্রম করে বেলা ৩টে নাগাদ পৌঁছলাম ঝালদা শহরে। উদ্দেশ্য বাংসা পাহাড় দেখে মুরগুমাতে রাত কাটিয়ে পরের দিন অযোধ্যা ছুঁয়ে ফিরে যাবো নিজেদের শহরে। মুরি শহর থেকে ঝালদা শহরের
 দূরত্ব ৪কিমি,১০মিনিটে পৌঁছলাম তুলিনে।বাংসা পাহাড় হলো পুরুলিয়া জেলার ছোট্ট পাহাড়ি, এক অজ পাড়াগাঁ।জনপদ ছাড়িয়ে সবুজ গাছের আড়ালে নিজের সৌন্দর্যকে লুকিয়ে রেখেছে বাাংসা পাহাড়। প্রকৃতির নিভৃত আঁচলের তলায় মুখ লুকানো বাংসা পাহাড় দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। ভীষণ মনকাড়া জায়গা।স্হানীয় লোকের কথা অনুযায়ী পুরুলিয়া জেলার এই  ছোট্ট অঞ্চলের নামকরণের পিছনে এক অলৌকিক ঘটনা লুকিয়ে আছে।যেটাকে লোককাহিনী ও কিংবদন্তি বলা যেতে পারে।এই গ্রামে বাংসা বাবা নামে এক বৃদ্ধ থাকতেন।ওই বৃদ্ধকে গ্রামের কোন ও এক বাসিন্দা এঁটো থালায় খেতে দেন। তারপর আর বাংসা বাবার   হদিস পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষ বাংসা  বাবাকে ফিরে পাওয়ার জন্য পুজো করতে শুরু করলেন। সেই থেকেই বাংসা ঠাকুরের পুজোর প্রচলন শুরু হল , আর তাঁরই নামে নামকরণ হল বাংসা গ্রাম ও বাংসা পাহাড়। পাহাড়ের দিকে পা বাড়াতেই দেখলাম গাছতলায় রাখা রয়েছে দেব- দেবীর মূর্তি। আর একটু এগিয়ে দেখলাম একটি ছোট্ট মন্দির। মন্দিরের মাথায় লেখা আছে বাংসা ঠাকুর। জানলাম, পৌষ মাসে বড় মেলা বসে। চোখে পড়ল পলাশের উজাড়  করা অপার সৌন্দর্য্য।নকশা করা মাটির বাড়ি। বাড়ির উঠোনে মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। একটা ছোট্ট চায়ের দোকান দেখলাম। সবাই চা ও বিস্কুট খেলাম। দেখলাম আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর ঘরবাড়ি।এই সবকিছু কে ঘিরেই বাংসা গ্রামের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।আর এরই কোলে গড়ে উঠেছে মনহরণকারী  বাংসা
 পাহাড়।


আমরা প্রত্যেকে পাহাড় প্রেমিক।এই পাহাড়ের উল্টোদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে,  আর একটা নাম না -জানা পাহাড়, সেটাও কিছুটা বাংসা পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে।এই দুই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। একটুকরো সবুজের মাঝে তুলিন রেল স্টেশন। গাড়ি আসা -যাওয়ার শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে বাংসা পাহাড়ের চারিদিক। বাইরের পৃথিবীর  থেকে  মনে হয়, যেন অনেক দূরে।  পাহাড়কে জড়িয়ে  রেখেছে  পলাশ, শিমুল ,হরিতকি আর করঞ্চের  দল । সুন্দর আকৃতির পাথরের গঠনে আমরা আকৃষ্ট ও মুগ্ধ হয়ে পড়ি।  এক সঙ্গেই বলে উঠলাম--'বাংসা তুমি কত সুন্দর'! পাহাড় থেকে দূরে দেখলাম তিনটি গ্রাম মেটাল,মারু,ও অর্ডার। আর দূরে বয়ে চলা নাম  না- জানা নদী। প্রকৃতির এই সুন্দর শান্ত পরিবেশ থেকে ঘরে ফিরতে কার- ই বা মন চায়! ফিরতেই হবে,কেন না, আমরা সবাই সময়ের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা। বিদায়ী মন ফিরে ফিরে চায় বাংসার দিকে অপলক নয়নে। উথালপাথাল এক মানসিক অস্হিরতার মধ্যে মনে পড়ে গেল:'আকাশ ডাকে আজ আমায়/পাহাড় ডাকে  আজ আমায়।'সত্যিই  ,বাংসা যেন আমাদের বিদায় দিতে চাইছে না।বেলা তখন ৪টে।সন্ন্যাসীলজ,১০০বছরের বটবৃক্ষ,pwd-এর বাংলো ও তুলিন স্টেশন ঘুরে আমরা চললাম মুরগুমা লেকের উদ্দ্যেশে। রাত কাটাবো ঐ খানের সেচ বিভাগের গেস্ট হাউসে । বেগুনকোদর   বাজার থেকে দূরত্ব তিন কিমি। বাজার ছাড়াতে  ধুলো ওড়া পথ। পথ ছবিতে সবুজের সঙ্গে আদিবাসী মানুষজনের ঘর-দুয়ার।ঝলক দর্শনেই মেলে স্হানীয়দের রোজ নামতার ছবি। গ্রাম ফুুঁড়ে় রাস্তা উঠেছে  বাঁধের উপরে। অবশেষে মুখোমুখি হলাম মুরগুমার সঙ্গে । সাহেবজোর নদীর উপর কৃত্রিম লেক। সবুুুজে ঘেরা এই লেকের দৃশ্য অতুলনীয়। একটি, দুটি পাহাড়    ঢুকছে দৃশ্যমান হয়ে।  

আর দূরে সর্ষে ফুলের খেতটি যেন, পাহাড়ের পায়ের উপরে মেলে দেওয়া হলুদ  বর্ডারে সবুজ শাড়িটি মাঘের রৌদ্রে শুকোচ্ছে।   পথের ধারে  পাহাড়তলিতে শিমুল-পলাশেের দাবানল। দূরে দলমা পাহাড়ের হাতছানি। গোধূূলির আলোয় মুরগুমা  বড় মায়াময়, অপার্থিব সুন্দর।  মায়াবী নীলাঞ্জন মাখানো ছবির মতো সুন্দর।অনায়াসে কাটিয়ে  দেওয়া যায়  গোটা রাত। রাতের খাওয়ার শেষ হলো দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে। সবাই চলে এলাম লেকের পাড়ে। সৌভাগ্য বশত দিনটি ছিল ভরা চাঁদের রাত।  এক মায়াবি জগৎ।মন ছুঁয়ে যায়় কল্পলোকে।পরতে পরতে প্রকৃতির অকৃপণ উজাড়  করা অপার সৌন্দর্য্য।আমরা লেকের  অন্যপ্রান্তে  চলে এলাম । রাতে দৃশ্যমান হল দলমারেঞ্জ। মৌনতার নীরব সাক্ষী।  মায়াবী চাঁদের আলো এখানে পথে পথে আল্পপনা এঁকে এঁকে চলেছে।রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো। ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম সকলে। ভাবছি,এবার তো ফিরে যাওয়ার পালা। নতুন সকালের জন্য অপেক্ষা।সময় যেন কিছুতেই কাটছে চাইছে না। পরেরদিন, নতুন ভোরে এক অন্যরূপ দেখলাম মুরগুমার। শান্ত,স্নিগ্ধ। ভোরের  সূর্যোদয়ের দৃশ্য এককথায় অতুলনীয়।টিফিন করে গোটা ঝালদা শহরটা ঘুরেনিলাম। ছোট্ট পৌরসভা। জনসংখ্যা  ২০০০০।একে একে শিকার ,শিলফোর ,কালিপাহাড়,নহবাহড়়াড্যাম ,বহুপ্রচীন মন্দির-- সব কিছুই দেখলাম। দুপুরের খাওয়া পর্ব এখানকার রাজদূত হোটেলে সারলাম।বেলা২টায় ঘরে ফেরার পথ ধরলাম।অন্য পথে  ফিরছি ।ঝালদা -    বাগমুণ্ডি--    মাঠাপাহাড়-ছড়িদা- বলরামপুর ,বান্দোয়ান ,ঝিলিমিলি-রানীবাঁধের পথে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।শীত,বসন্ত ও বর্ষায় অপরূপা মুরগুমা  ও  বাংসা ।বিভিন্ন জনপদভূূূমি ছুঁয়ে এগোতে লাগলাম । দূরত্ব ১৫০কিমি। এই অঞ্চল টি যেন পলাশের আর কুসুম ফুলের বাড়াবাড়ি উপস্থিতি ।মন পাগল করে দেয়।ফলে এই প্রকৃৃৃতি রঙের দাবানল দেখতে দেখতেই ফিরছি। সময়ের হাত ধরে সূর্য ডোবার পালা এসে গেলো। বসন্তের  পড়ন্ত বিকেল
বেলায় পলাশের জঙ্গলের সঙ্গে আকাশের এই রঙের খেলার সাক্ষী আমরা ৮ জন।একে একে বাংসা আর মুরগুমার বিরল স্মৃতিকে  সঙ্গী  করে গাইতে লাগলাম ঘরে ফেরার সুর।এই পথ যদি না শেষ  হয়--কিছুক্ষণ বাদে সবাই সমবেতভাবে গেয়ে উঠলাম' ও শিমুল,ওপলাশ  দাও রাঙিয়ে দাও' 

 পশ্চিমবঙ্গ,ভারত ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ