সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

মধুসূদন দত্ত ও মেঘনাদবধ কাব্য

 

অমিত মজুমদার 


অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা "মেঘনাদবধ কাব্য" প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। একটা মজার গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করি। গল্পটা শৌরীন্দ্রকুমার ঘোষের লেখা 'সাহিত্যিক কৌতুকী' বই থেকে সংগ্রহ করা। "একবার লাইব্রেরীতে মধুসূদন বিশ্রাম করছিলেন, এমন সময় এক উকিল তাঁকে বললেন — মশাই, 'মেঘনাদবধের' নরকবর্ণনাটা আপনি নিশ্চয়ই মিলটন থেকে নিয়েছেন, ঠিক না ? মধুসূদন হেসে মহাকবি দান্তের 'নরকবর্ণনা' কতকটা আবৃত্তি করে শোনালেন, তারপর আবার মিলটন থেকে 'নরকবর্ণনা' শোনালেন। পরে বললেন — এই দেখুন, মিলটন যেখান থেকে ভাবগ্রহণ করেছেন, আমিও সেখান থেকে নিয়েছি। 
আবার বললেন  — গঙ্গাজল যদি খেতে হয় তবে সাধ্য হলে হরিদ্বারের নির্মল জল খাওয়াই উচিত, কলকাতার গঙ্গার নোনা জল না খেয়ে।"

 "মেঘনাদবধ কাব্য" উনিশ শতকের মহাকাব্য। আগেই বলা হয়েছে এই কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। সেই সময় তাঁর আশেপাশের কবি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারীলাল চক্রবর্তী, নবীনচন্দ্র সেন, স্বর্ণকুমারী দেবী, কামিনী রায় প্রমুখ। আবার ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও জন্ম এই সালে। কিছুদিন আগে (১৮৫৭) সিপাহী বিদ্রোহ হয়ে গেছে। এই সময়টাও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে বঙ্গ সমাজে বেশ কিছু আন্দোলনের তরঙ্গ উঠেছিলো। একটু আগে থেকে ধরলে বলতে হয়, রামমোহন রায়ের আবির্ভাব, হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষকুমার দত্তের পর মধুসূদন দত্তর আগমন হয়। ১৮৫৯ সাল থেকে ব্রাহ্ম সমাজে একটা নতুন শক্তির সঞ্চার দেখা যায়। একদিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যদিকে কেশবচন্দ্র সেন সকলের নজরে এলেন। দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র এক হলেন। স্থাপন হলো ধর্ম শিক্ষার্থ ব্রহ্মবিদ্যালয়। প্রতি রবিবার সকালে ওই বিদ্যালয়ে দেবেন্দ্রনাথ বাংলায় ও কেশবচন্দ্র ইংরেজিতে উপদেশ দিতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ বইতে লিখেছেন, "১৮৬১ সাল থেকে ব্রাহ্মধর্ম্মকে অনুষ্ঠানে পরিণত করিবার জন্য ব্যাগ্রতা দৃষ্ট হইতে লাগিল। ঐ সালে দেবেন্দ্রনাথ তাঁহার দ্বিতীয়া কন্যার বিবাহ ব্রাহ্মধর্ম্মের পদ্ধতি অনুসারে দিলেন। এদিকে যুবক ব্রাহ্মদলে অনেক ব্রাহ্মণের সন্তান জাতিভেদের চিহ্নস্বরূপ উপবীত পরিত্যাগ করিয়া নানা প্রকার সামাজিক নিগ্রহ ও নির্যাতন সহ্য করিতে লাগিলেন। দেশমধ্যে মহা আন্দোলন উপস্থিত হইল।" এমনই এক সময়ে রচিত হলো 'মেঘনাদবধ কাব্য'।
 

কবির জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫ শে জানুয়ারি। উনিশ বছর বয়সে ১৮৪৩ সালে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নামের আগে 'মাইকেল' শব্দটা বসে যায়। মনেপ্রাণে তাঁর ইচ্ছা ছিলো ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করবেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে খ্যাতির অধিকারী হবেন। কবি ১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ পর্যন্ত মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) কাটান। সেই সময়  'Spectator' নামে পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এছাড়া 'Athenaeum' ও 'Hindu Chronicle' নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। মাদ্রাজে থাকাকালীনই 'The Captive Lady' ও 'Visions of the Past' গ্রন্থ দুটি প্রকাশ করেন। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য রচনা কবিকে সাফল্য এনে দেয়নি। 'The Captive Lady' পাঠ করে কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সভাপতি ড্রিংকওয়াটার বেথুন মন্তব্য করেছিলেন, "He could render far greater service to his country and have a better chance of achieving a lasting reputation for himself, if he will employ the taste and talents, which he has cultivated by the study of English, in improving the standard and adding to the stock of the poems of his own language, if poetry at all events he must write." বেথুনসাহেবের এই মন্তব্য কবি শুনেছিলেন তাঁর মাদ্রাজ প্রবাসী বন্ধু গৌরদাসের কাছে। এই মন্তব্য কবির মনে সুদুরপ্রসারি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এরপর কবি ইংরেজি ছেড়ে মাতৃভাষা বাংলাতে কাব্যচর্চা শুরু করেন। কবির লেখা 'বঙ্গভাষা' কবিতার মধ্যেও এই বিষয়টা ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছিলেন, "হে বঙ্গ,  ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন ;— / তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, / পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ / পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি। / কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!"

        'মেঘনাদবধ কাব্য'টি হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ অবলম্বন করে রচনা করা৷ মোট নয়টি সর্গে বিভক্ত। এর মধ্যে অবশ্য বিদেশি নানা মহাকাব্যের ছাপও লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ১৮৫৯ সালে তিনি প্রথম এই ছন্দ ব্যবহার করেন। সেটা ছিলো 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য'। এই কাব্য উপহার পেয়ে কবির সহপাঠী রাজনারায়ণ বসু ১৯শে জুন ১৮৬০ - কবিকে লিখেছিলেন, ( দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ তৎসম্পাদিত 'সোমপ্রকাশ' ৬ই আগস্ট, ৮৬০) "বাঙ্গালা ভাষায় অমিত্রাক্ষর পদ্য নাই। কিন্তু অমিত্রাক্ষর পদ্য ব্যতিরেকে ভাষার শ্রীবৃদ্ধি হওয়া সম্ভাবিত নহে। পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, প্রভৃতি যে সমস্ত পদ্য আছে, তা মিত্রাক্ষর। কোন প্রগাঢ় বিষয়ের রচনায় তাহা উপযোগী নহে।... এখন আব লোকের মন সুখময় আদিরস সাগরে মগ্ন হইতে তাদৃশ উৎসুক নহে। এখন দিন দিন লোকের মন যেমন উন্নত হইতেছে তেমনি উন্নত পদ্য সৃষ্টিও আবশ্যক হইয়াছে। অতএব মাইকেল মধুসূদন দত্তের চেষ্টা যথোচিত সময়েই হইয়াছে সন্দেহ নাই।" কবি 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' উৎসর্গ করেছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে। উৎসর্গকালে তিনি লিখেছিলেন "যে ছন্দবন্ধে এই কাব্য রচিত হইল, তদ্বিষয়ে আমার কোন কথাই বলা বাহুল্য ; কেননা এরূপ পরীক্ষা-বৃক্ষের ফল সদ্যঃ পরিণত হয় না। তথাপি আমার বিলক্ষণ প্রতীতি হইতেছে যে এমন কোন সময় অবশ্যই উপস্থিত হইবেক, যখন এদেশে সর্ব্ব সাধারণ জনগণ ভগবতী বাগদেবীর চরণ হইতে মিত্রাক্ষর-স্বরূপ নিগড় ভগ্ন দেখিয়া চরিতার্থ হইবেন। কিন্তু হয় তো সে শুভকালে এ কাব্য-রচয়িতা এতাদৃশী ঘোরতর মহানিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকিবেক, যে কি ধিক্কার, কি ধন্যবাদ, কিছুই তাহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিবেক না।" 
        কবির ভবিষ্যৎবাণী কিন্তু সত্যি হয়েছিলো। এই ছন্দ-প্রবর্তনে শুধুমাত্র বাংলা কাব্য নয় বাংলা গদ্যও অনেকটা যেন মুক্ত বাতাস পেয়ে সতেজ হবার অবকাশ পেয়েছে। 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' রচনার এক বছর পরে কবি রচনা করেন তাঁর অমর সৃষ্টি 'মেঘনাদবধ কাব্য'। এটি দুই খণ্ডে প্রকাশ পায়। প্রথম খণ্ড (১-৫ সর্গ)  ১৮৬১ সালের জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় খণ্ড (৬-৯ সর্গ) সেই বছরেই আর কিছুদিন পরে প্রকাশিত হয়। মেঘনাদবধ কাব্যের ১ম খণ্ড প্রকাশ হবার পর বাংলায় অমৃতাক্ষর ছন্দের যথাযথ প্রবর্তন হয়। এই আনন্দে গুণগ্রাহী কালীপ্রসন্ন সিংহ তৎপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে নিজের বাড়িতে ১৯৬১ সালের ১২ই জানুয়ারি মধুসূদন দত্তর সম্বর্ধনা সভার অনুষ্ঠান করেন। অনুষ্ঠানে হাজির বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি। উপস্থিত ছিলেন রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রমাপ্রসাদ রায়, কিশোরীচাঁদ মিত্র, পাদরি কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, গৌরদাস বসাক প্রমুখ। বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে কালীপ্রসন্ন সিংহ কবিকে একটা মূল্যবান রজত মানপত্র উপহার দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিলো, "আপনি বাঙ্গালা ভাষায় যে অনুত্তম অশ্রুতপূর্ব্ব অমিত্রাক্ষর কবিতা লিখিয়াছেন, তাহা সহৃদয় সমাজে অতীব আদৃত হইয়াছে, এমন কি আমরা পূর্বে স্বপ্নেও এরূপ বিবেচনা করি নাই যে, কালে বাঙ্গালা ভাষায় এতাদৃশ কবিতা আবির্ভূত হইয়া বঙ্গদেশের মুখ উজ্জ্বল করিবে। আপনি বাঙ্গালা ভাষার আদি কবি বলিয়া পরিগণিত হইলেন, আপনি বাঙ্গালা ভাষাকে অনুত্তম অলঙ্কৃত করিলেন, আপনা হইতে একটি নূতন সাহিত্য বাঙ্গালা ভাষায় আবিস্কৃত হইল, তজ্জন্য আমরা আপনাকে সহস্র ধন্যবাদের সহিত বিদ্যোৎসাহিনী সভাসংস্থাপক প্রদত্ত রৌপ্যময় পাত্র প্রদান করিতেছি।" এখানে উল্লেখ্য মধুসূদন দত্তকে অনুসরণ করেই কালীপ্রসন্ন সিংহই প্রথম অমৃতাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেছিলেন তাঁর 'হুতোম প্যাঁচার নকশা'তে (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের গোড়ায় এই ছন্দে দুটি কবিতা আছে )। 

মেঘনাদবধ কাব্যে'র প্রথম সমালোচক ও কবির সহপাঠী রাজনারায়ণ বসু লিখেছিলেন, "কবি স্বদেশীয় লোকদিগের মনোরঞ্জনার্থে রাম, লক্ষ্মণ, ও সীতার প্রতি যতদূর সাধ্য মমতা প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করেন নাই ; কিন্তু রাক্ষসদিগের প্রতি তাঁহার বাস্তবিক পক্ষাপাতও গোপন করিতে পারেন নাই। মিল্টনের ক্রাইষ্ট অপেক্ষা সেটান নায়ক নামের অধিক উপযুক্ত, কিন্তু আমাদিগের কবিতে ও তাঁহাতে প্রভেদ এই যে, মিল্টন অজ্ঞাতসারে এই প্রমাদে পড়িয়াছেন, আমাদিগের কবি জানিয়া শুনিয়া এই প্রমাদে পড়িয়াছেন।" পরবর্তীকালে অবশ্য রাজনারায়ণ বসুর মতের পরিবর্তন হয়েছিল। কারণ তারপর সামাজব্যবস্থারও অনেক পরিবর্তন হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছিলেন, "দত্ত কবি রামচন্দ্রের পবিত্র চরিত্র অবলম্বন করিয়াই মেঘনাদবধ কাব্য লিখিয়াছেন। কিন্তু ইহার নায়কগণ এমনই যথাযোগ্য গুণে বিভূষিত যে, তাহাতে রামায়ণ-প্রচারয়িতা বাল্মিকীকেও লজ্জিত হইতে হইয়াছে। যদি প্রস্তাব সসংস্কৃত ভাষায় লিখিত হইত তাহা হইলেও বাল্মিকী-রচিত রামায়ণ কোন গুণেও ইহার নিকট লক্ষিত হইত না।" 

কাব্যটি বাংলা সাহিত্যের নতুন ধরা সৃষ্টি করলেও রামচন্দ্রের চরিত্র নির্মাণ নিয়ে সামান্য প্রশ্ন উঠলেও বিতর্ক জন্ম নেয়নি । সাহিত্যরসিক ভোলানাথ চন্দ্র লিখেছিলেন, "Rama is the great Brahmanical hero, but he did not come up to Madhu's ideal. By conservatism, he would have pleased his countrymen but outraged his own instincts." (২রা সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪)  তবে কাব্যটি প্রকাশের দশ বছর পরেও নবিশিক্ষিত সম্প্রদায় বিষয়বস্তুর অ-হিন্দুপ্রকৃতি নিয়ে কোনোরকম শোরগোল তোলেনি। ক্যালকাটা রিভিউ-এ এক সমালোচক লিখেছিলেন, "The subject is taken from the Ramayana, the source if inspiration to so many Indian poets. In the war with Ravana Meghnada, the most heroic of Ravan's sons add warriors, is slain by Lakshman, Rama's brother. This is the subject ; and Mr Dutta owes a great deal more to Valmiki than the more story. But, nevertheless, the poem is his own work from story."  খ্রীস্টান পাদরী রেভারেন্ড লালবিহারী দে তাঁর নিজের পত্রিকা 'ইণ্ডিয়ান রিফর্মার'-এ নিন্দাসূচক সমালোচনা লিখলেন। সেই সমালোচনার জবাব দিয়েছিল 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট'। জবাবী প্রবন্ধের শেষ অংশে বলা হয়েছিলো, "If the   Reformer has no sympathy with anything that is Hindoo, all that we can do us to bow him out of the room politely! Being neither Greeks nor Romans nor believers in the Mosaic account of creation the Editors of the Vividartha need not blush if a Hindoo legend stirs up their feelings more than the poetry of Homer, Vargil and Milton. We should certainly call them silly, if they did violence to their feelings in order to show the world how very thoroughly they had been 'regenerated'." সেদিন কিন্তু হিন্দুপুরাণ অসম্মানিত হয়েছে কিংবা রামচরিত্রের ভয়াবহ বিকৃতিসাধন হয়েছে বলে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। উল্টে এই কাব্য সেই প্রজন্মের পাঠক সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছিলো। 


এই নিবন্ধে 'মেঘনাদবধ কাব্যে'র সাহিত্যগুণ নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি না। সে ধৃষ্টতা বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। তবে শুরুটা করেছিলাম 'নরক বর্ণনা' দিয়ে তাই অষ্টম সর্গের কিছুটা অবতারণা করছি। কাব্যে ২য় ৩য় ৫ম সর্গে বর্ণিত বিষয়ের মতো ৮ম সর্গে বর্ণিত বিষয়ের মধ্যেও রামায়ণের কোনো সম্পর্ক নেই। রামায়ণে বলা আছে রাবণের শক্তিশেলাহত লক্ষণের জন্য রামচন্দ্র বিলাপ শুরু করলে ভেষজতত্ত্বজ্ঞ বানর সুষেণ লক্ষণের দেহের বর্ণ ও অন্যান্য চিহ্ন পর্যবেক্ষণ করে রামচন্দ্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, লক্ষণের মৃত্যু হয়নি। বিশল্যকরণী, সাবর্ণ্যকরণী, সঞ্জীবকরণী ও সন্ধানী এই চারপ্রকার ওষুধ আনা সম্ভব হলে লক্ষ্মণকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। এরপর হনুমানকে ওষুধ আনতে পাঠানো হয়। হনুমান ওষুধের গাছ চিনতে না পেরে সমগ্র পর্বত তুলে নিয়ে আসে। কিন্তু মেঘনাদবধ কাব্যে আমরা অন্য ঘটনা দেখতে পাই। এখানেও অষ্টম সর্গের শেষ দিকে হনুমানকে ওষুধ আনতে পাঠানো হয় তবে এই ওষুধের সন্ধান রামচন্দ্র পেয়েছিলেন মায়াদেবীর সাহায্যে প্রেতপুরীতে যাবার পর। সেখানে রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মৃত পিতা দশরথের সঙ্গে দেখা হয়। দশরথের কাছ থেকেই রামচন্দ্র ওষুধের সন্ধান পেয়ে থাকেন। এই প্রসঙ্গেই কবি রামচন্দ্রের প্রেতপুরী দর্শনের যে বর্ণনা করেছেন তা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর মধ্যে ভার্জিল ও দান্তের প্রভাব সুস্পষ্ট। 


'মেঘনাদবধ কাব্যে'র গঠন কৌশল নিয়ে কবি নিজে বলেছিলেন, "I think I have constructed the poem on the most rigid principles, and even a French critic would not find fault with me." এই কাব্যে গ্রীক পুরাণের প্রভাব যেমন আছে তেমন আছে হিন্দু পুরাণের প্রভাবও। দুটোর মধ্যে চমৎকার যুগলবন্দী এনেছেন কবি। বাল্মিকীর রাম দৈবশক্তিতে বলীয়ান। অন্যদিকে মধুসূদনের রাবণ দুর্জয় আত্মশক্তি ও নির্ভিক হৃদয়ের অধিকারী। যে নিজের পুত্রের মৃত্যুতে চরম আঘাত পেলেও কিন্তু ভেঙে পড়েনি। 


গ্রীক পুরাণ কবির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আবার উনিশ শতকের মানবতার আদর্শেও কবি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই কারণে তৎকালীন আমাদের দেশের প্রচলিত কাহিনীর ওপর বিদেশী ভাবধারার প্রয়োগ করে কবি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন স্বতন্ত্র একটা ধারা। সেই ধারারই ফসল ছিলো মেঘনাদবধ কাব্য। যদিও সুকুমার সেন বলেছেন, "হোমার, ভার্জ্জিল, দান্তে, মিলটন প্রভৃতি ইউরোপীয় কবিগণের অনুসরণে মধুসূদন বাঙ্গালায় মহাকাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, ইহা সত্য কথা। কিন্তু মধুসূদনের মহাকাব্য অনুকরণ নহে, ইহা তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। বহু ভাষা ও সাহিত্যের বসবেত্তা কবির লেখার মধ্যে প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য ভাবের যে সমন্বয় ঘটিয়াছে তাহা অপর কোনো বাঙ্গালী সাহিত্যিকের রচনায় এতাবৎ দেখা যায় নাই।" তিনি আরো বলেছেন , "বাঙ্গালা সাহিত্যে বীররসের অবতারণা করিবার পক্ষে প্রধান অন্তরায় ছিল বাঙ্গালা ভাষার ও ছন্দের ওজোহীনতা। কবি প্রথম দোষ শুধরাইয়া লইলেন প্রচুরভাবে আভিধানিক সংস্কৃত শব্দ গ্রহণ করিয়া এবং নামধাতুর সৃষ্টি করিয়া। আর ছন্দের ওজোহীনতা নিরাকরণ করিলেন অমিতাক্ষর পয়ার প্রবর্ত্তন করিয়া। প্রায় সকল বাংলা ছন্দের মূলে পয়ার ; পয়ারের প্রধান লক্ষ্মণ হইতেছে অষ্টম ও চতুর্দশ অক্ষরের পর যতি এবং শেষ যতিতে মিল। যতির স্থান নির্দিষ্ট থাকায় পয়ারে ঝঙ্কারময় ওজস্বী সংস্কৃত শব্দ বেশীমাত্রায় প্রয়োগ করা অসম্ভব ছিল, এবং চরণের শেষে মিল থাকায় বাক্য এবং ভাব দুই চরণে শেষ করিতেই হইত। অসীম প্রতিভাবলে মধুসূদন এই দুই বাধা অবলীলাক্রমে অতিক্রম করিলেন। তিনি যে অমিতাক্ষরের সৃষ্টি করিলেন তাহা মোটেই বিদেশী আমদানি নহে, ইহার মূলে বাঙ্গালা পয়ারেরই ধ্বনিপ্রবাহ এবং নির্দিষ্ট অক্ষরসংখ্যা রহিয়াছে, কেবল অন্ত্য অনুপ্রাস নাই এবং অষ্টম অক্ষরে যতি অবশ্যম্ভাবী নহে। বাঙ্গালা ছন্দঃ স্বীয় বিশিষ্টতা সসম্পূর্ণভাবে রক্ষা করিয়াই এই অভূতপূর্ব নূতন রূপ পাইল। বাঙ্গালা সাহিত্য নবজন্ম লাভ করিল।"

শুরুর মতো "সাহিত্যিক কৌতূকী" বইটা থেকেই আবারও একটা মজার গল্প দিয়েই এই নিবন্ধ শেষ করি। "মেঘনাদবধ-কাব্য যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন একদিন মধুসূদন কোনো কাজের জন্য চীনাবাজারে গিয়েছিলেন। সেখানে দেখেন এক দোকানদার তার দোকানের সামনে বসে একমনে 'মেঘনাদবধ' পাঠ করছেন। 
        রহস্যপ্রিয় কবি কৌতূহলাবিষ্ট হয়ে দোকানে ঢুকে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন — মশাই কি বই পড়ছেন ? 

        দোকানী বললে — আজ্ঞে একখানি নতুন কাব্য। 
        মধুসূদন — কাব্য, বাংলা ভাষায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কবিতাই নেই, তা আবার কাব্য। 
        দোকানী — সে কি মশাই, মাত্র মাত্র এই একখানি কাব্যই তো যে কোন জাতির ভাষাকে গৌরবান্বিত করতে পারে। 
        মধুসূদন — তাই নাকি, কি রকম কাব্য, একটু পড়ুন তো দেখি। 
        এই কথা শুনে সেই সাহিত্যপ্রিয় দোকানী সাহেববেশী মধুসূদনের মুখের দিকে সন্ধিগ্ধ চোখে দেখে তাঁকে বললেন — আমার মনে হয় আপনি এই বইয়ের ভাষা ঠিক বুঝতে পারিবেন না। 
        মধুসূদন — কেন ? এর ভাষাটা কি খুব কঠিন নাকি ?  ভালো, একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি —  
        অগত্যা সেই দোকানদার যেখানে পড়ছিল — সেই অংশ পাঠ করতে লাগল — 
        "........বাঁচালে দাসীরে
        আশু আসি তার পাশে হে রতিরঞ্জন।" ইত্যাদি। 
        কিছুক্ষণ পরে সে থামলে, মধুসূদন তার হাত থেকে বইখানি নিয়ে তাঁর গুরুগম্ভীর স্বরে নিজে পাঠ করতে লাগলেন। তাঁর পাঠের ভাবভঙ্গি দেখে, উচ্চারণের লালিত্য শুনে মুগ্ধ হয়ে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে — মশাই আপনি এখানে কোথায় থাকেন ? 
        মধুসূদন সে কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — আচ্ছা এই অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা ভাষায় চলবে কি? 
        দোকানী — খুব চলবে মশাই। খুব চলবে, এ এক নতুন সৃষ্টি। নতুন ছন্দ.... আরও কি বলতে যাচ্ছিল, মধুসূদন তখন আনন্দে হাসতে হাসতে ব্যস্তভাবে তার সঙ্গে করমর্দন করে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।"
        কবি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখলেন "মেঘনাদবদ কাব্য" বাকিটা চিরস্থায়ী জায়গা নিয়ে নিলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। 



তথ্যসূত্র — 

১. মধুসূদন দত্ত — শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় 
২. মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবন ও সাহিত্য — অধ্যাপক সুরেশচন্দ্র মৈত্র 
৪. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আধুনিক যুগ — আজহার ইসলাম 
৪. সাহিত্যিক কৌতুকী — শৌরীন্দ্রকুমার ঘোষ 
৫. বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা — শ্রীসুকুমার সেন
৬. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ — শিবনাথ শাস্ত্রী 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ