সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

একটি কষ্টের ভালোবাসার গল্প



সাকিব হোসেন নাঈম

ফেরদৌসির সাথে সম্পর্কচ্ছেদের  দু' বছর যেতে না যেতেই নতুন ভবিষ্যতের মোহে নিলুফাকে অর্ধাঙ্গিনীর মুকুটটা প্রদান করেছিলাম। খুব যে ভালো আছি তা নয়। তবে নিলু আমায় ঢের বোঝে। সেদিক থেকে পূর্বাপেক্ষা সার্থক। কিন্তু সত্য তো এটাই যে, কর্মের সার্থকতা অপেক্ষা মনের সার্থকতা জরুরী। 

সেদিন বাজার থেকে ফিরছিলাম । এক বৃদ্ধা হাজির। "আব্বা এক সের চাইল দেবেন? পোলাডার কাম কাইজ বন্ধ, ঘরে চাইল নাই "। তার অশ্রুশিক্ত নয়নযুগল আমায় ফেরদৌসিকে মনে করিয়ে দিল। অসহায়ের সহায় হওয়ার এক প্রবল শখ ছিল ওর। ও হলে হয়তো কখনও ফিরিয়ে দিতনা এ বৃদ্ধাকে। ওনার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বেশ চেনা মুখ মনে হলো। কোথায় যেন দেখেছি। হ্যাঁ ভার্সিটিতে প্রথম যেদিন ফেরদৌসীকে দেখেছিলাম সে এই বৃদ্ধাকেই দান করছিল। আমি সেদিন কাছে যেতেই সে হনহনিয়ে চলে গেল। আমি বৃদ্ধাকে সেদিন দুই টাকার একটি নোট দিলে বৃদ্ধা সাথে সাথে বলে উঠল," কি দিলেন মিয়া? আইজকাইল দুই ট্যাকা দিয়া কিচ্চু অয়না। দিলে দশ ট্যাকা দ্যান নইলে দেওয়াই লাগবো না"। আমি তৎক্ষনাত থ হয়ে গেলাম। আজকাল ভিক্ষুকরাও হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করে।এ যেন আমার কাছে তার পাওনা। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম কেউ দেখে ফেলল কিনা। কেউ দেখেনি, যাক মানইজ্জত বাঁচলো। আমি বৃদ্ধাকে দশ টাকার কচকচে নোটটি দিলাম। বৃদ্ধা এবার মহা খুশিতে আমাকে দোয়া করতে শুরু করে দিল। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম," খালা এত দোয়া আমার লাগবে না, আপনি শুধু এই দোয়া করেন আমি যেন এইমাত্র আপনারে দান কইরা যাওয়া মেয়েটারে সারাজীবনের জন্য পাই"। বৃদ্ধা প্রথমে হাঁসলেন। তারপর আমাকে সেই দোয়াই করলেন। এতবছর  পরে তাকে আবার দেখব তা ভাবিনি।যদিও দেখতে একেবারে আগের মতো নেই। চুলের পাকটা বেড়ে গেছে, প্রায় সবই সাদা। তবুও চিনতে ভুল করিনি। অতবড় একটা দোয়া যে করেছিল তাকে কি করেই বা ভুলি। আগামীকাল তোমার বাসায় শুধু চাল নয় সব বাজার চলে যাবে, এই বলে তার বাসার ঠিকানা নিয়ে চলে এলাম। বৃদ্ধা খুশিতে গদগদ হয়ে আমাকে দোয়া করতে শুরু করলেন।  আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম," আমাকে তোমার দোয়া করতে হবেনা। তোমার দোয়া আমার কাজে আসেনা"। বৃদ্ধা মনে হয় কথাটায় কষ্ট পেল। সে কিছুই বুঝতে পারলো না। আমি তাকে সব খুলে বললাম। তিনি আমাকে আস্বস্ত করে বললেন," চিন্তা কইরো না বাবা তুমি তার দ্যাখা আবার পাইবা"। আমি বাসার দিকে হাঁটলাম। পাঁচ/ছয় বছরে যার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ  নাই, বৃদ্ধার এক মুহুর্তের দোয়াতে তার সাথে দেখা হয়ে যাবে এরুপ বোকামি ভাবনা আমি লালন করিনা।

মনটা মানছিল না। আগামিকালটা বেশ দেরি হয়ে যায় বলে মনে হলো। তাই সেদিন বিকেলেই বাজার নিয়ে বৃদ্ধার বাসায় পৌঁছলাম। ঘরের সামনে যেতেই ভিতর থেকে একজন বের হলেন, বৃদ্ধা তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করছেন। সামনে ফিরতেই তার চোখে চোখ পরল আমার। দেহ নিস্তব্ধ হয়ে এলো। চোখদুটো ছলছল করছিল। সেও তাকিয়ে রইলো। কপল বেয়ে অশ্রু তার জামা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। আমি ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, "কেমন আছ?" সে জবাব দিল না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, "স্বামী-সন্তান কেমন আছে?" সে উত্তর দিল বিয়ে করিনি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম,কেন? "সেদিন কাবিনের টাকা আর ডিভোর্স পেপারের জন্য নয় বরং তুমি এসে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এই অপেক্ষায় ছিলাম আমি", এই বলে ও কাঁদতে কাঁদতে সোজা স্টেশন রোডের দিকে চলে গেল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার কিন্তু কিছুই বলতে পারলামনা। তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে যতদুর পর্যন্ত ওকে দেখা যাচ্ছিল আর ভাবছিলাম, হায়, বৃদ্ধা যদি সকালে পুনর্মিলনের আশীর্বাদটা করতো!

সুবিদপুর, নলছিটি, ঝালকাঠি


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ