সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে [পর্ব-০৬]

গৌতম সরকার

দিনগুলো আস্তে আস্তে গতি পাচ্ছে। সময়ের পাখা মেলে একটা একটা দিন কাটতে লাগলো আর মানুষগুলো এই ট্রেনজীবনে আরোও স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে লাগলো। মানুষে মানুষে বিশ্বাস বাড়ল, কোন্দল কমলো; ভালোবাসা-নির্ভরতা বাড়ল, হিংসা-বিদ্বেষ কমে গেল। ইতিমধ্যে চারটি করে কামরা মিলে একটা করে কমিটি তৈরি করা হয়েছে, যাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওই নির্দিষ্ট কামরার মানুষগুলোর দেখভাল করার। তাদের অভাব-অভিযোগ শোনা, যথাযথ রেশন সরবরাহ করা, ব্যক্তিগত পর্যায়ের সমস্যা সমাধান করা, ইত্যাদি। আমাকে তো আমাদের কমিটিতে থাকছে হয়েছেই, বাকি কমিটিগুলোও ছাড়েনি। জোর করে কোনো না কোনো পদে রেখে দিয়েছে। আমার অবশ্য মন্দ লাগছেনা, আমি তো মনে মনে এদের সাথে মিশে এদেরই একজন হয়ে এই সফর করতে চেয়েছিলাম, আজ সেই চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া হয়ে গেছে। সকাল থেকে বেশ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে সময় কেটে যায়। রোজই কোনো না কোনো কমিটির মিটিং থাকে; তারপর কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কথা তো শুনতে হয়ই, সেগুলো সমাধানের পথও বাতলে দিতে হয়। তবে সমস্যা গম্ভীর হলে সেটা কমিটির কাছে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য পাঠানো হয়। সন্ধ্যেবেলা কিছু মানুষ আমার কাছে আসে গল্প করতে। তারা তাদের নিজেদের কথা বলে, আমার কথা শুনতে চায়, আমার মায়ের কথা শুনে চোখের জল ফেলে, আবার লেখাপড়া শিখে আমার এই অধঃপতনের কথা ভেবে তাদের গলায় আক্ষেপও ঝরে পড়ে। এর মধ্যে দেশ-দশের কথাও আলোচনায় উঠে আসে, মারণ ব্যাধি, চিন-জাপান-কোরিয়া-ইটালি হয়ে আলোচনার স্রোত কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকে তার কোনো হিসেবনিকেশ থাকেনা। কিন্তু আলোচনা রোজই গিয়ে শেষ হয় অজানা-অচেনা অনিশ্চিতপুরের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। সব হারানো মানুষগুলোর মুখে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-আশা-ভরসা-অনিশ্চয়তা-হতাশার ছবিগুলো চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো একের পর এক খেলে যায়। তবে সবাই চলে গেলেও বৈরাগী আমার পাশে বসে থাকে। সারাটা আলোচনায় থাকলেও কথা প্রায় বলেইনা। চুপচাপ বসে থাকে আর খুব ধীর লয়ে নিজের মনে গুনগুন করে গান গেয়ে চলে। সবাই চলে গেলে ও আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়। একদিন যখন আমি আর ও চুপচাপ বসে আছি হঠাৎ মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা বাবু , অনিশ্চিতপুর বলে সত্যিই কি কিছু আছে?" আমি চমকে উঠলাম। এরকম একটা প্রশ্ন উঠতে পারে আমি ভাবিওনি। বুঝলাম গুনগুন করে গান গাইলেও আলোচনার সব কথা সে শোনে, মানুষগুলো যে আশা-আকাঙ্ক্ষার নাগরদোলায় দুলতে থাকে সেটা সে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করে, কোনোকিছুই তার চোখ-কান এড়ায় না। আজ প্রশ্নটা করে গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কি উত্তর দেব ভেবে পাইনা। মানুষটি এক পলকের জন্যেও আমার মুখ থেকে চোখ সরায় না। এ প্রশ্নের কি উত্তর দেব ! এর কি সত্যি কোনো জবাব আছে ! আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চোখ নামিয়ে বলে ওঠে, "থাক বাবু, উত্তর দিতে হবেনা।" আমার তখন কিছু চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ; আমার সেই লজ্জাকে দীর্ঘায়িত হতে না দিয়ে সে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে....


" ধন্য ধন্য বলি তারে

বেঁধেছে এমন ঘর

শূন্যের উপর ফটকা করে।।

সবে মাত্র একটি খুঁটি

খুঁটির গোড়ায় নাইকো মাটি,

কিসে ঘর রবে খাঁটি

ঝড়ি-তুফান এলে পরে।।

মূলাধার খুঁটি নয়টা

তার ওপরে চিলে-কোঠা

তাহে এক পাগল বেটা

বসে এক একেশ্বরে ।।

উপরে নীচে সারি সারি

সাড়ে নয় দরজা তারি

লালন কয় যেতে পারি

কোন দরজা খুলে ঘরে।।



রাত্রে খাওয়া হয়ে যাবার পর বৈরাগী আবার আসে। আমিই বেশি কথা বলি। ও গুনগুন করে গলায় সুর তুলতে তুলতে শুনতে থাকে। একদিন আমি বললাম, "বৈরাগী, তোমার জীবনের গল্প বলো।" গান থামিয়ে একটুকু চুপ করে থেকে মুখ তুলে একটু হেঁসে জবাব দিলো, " বৈরাগীর আবার জীবন বাবু, বৈরাগী জন্মায় বৈরাগী হয়ে, দিন গুজরান করে গান গেয়ে, ভিক্ষা করে, বৈরাগী মরেও যায় বৈরাগীর বেশে। আমাদের জীবনে কোনো গল্প থাকেনা বাবু।"

আমি বললাম, "পাশ কাটালে হবেনা বৈরাগী; তোমার জীবনে নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে। তুমি যাই বলো, মানুষ এমনি এমনি বৈরাগী হয়না। তুমি নিশ্চয়ই কোনো বৈরাগীর ঘরে জন্মাওনি! তোমার একটা ছোটবেলা ছিল, বাবা ছিল, মা ছিল, পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন ছিল, সর্বোপরি তোমার একটা গ্রাম ছিলো; সেসবের কথা বলো।" অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো, গলায় আবার গুনগুন গান ফিরে এলো। মনে হল গানের সুরের ভেলায় চড়ে অতীতকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। কামরায় রাত্রির স্তব্ধতা বিরাজ করছে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। অন্ধকারের মধ্যে আকাশে আবছা কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে। আকাশ ঘুমায়নি, জানলার পাশে বসে খোলা বাতায়ন পথে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রয়েছে।

 গ্রামের নাম পলাশপুর। গ্রামের পাশ দিয়ে একটা নদীও বয়ে গেছে-- সুন্দরী। গরমের সময় জল শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে৷ লোকে পায়ে হেঁটে লোকে এপার ওপার করে৷ নদীর বুকে ঘাস গজিয়ে ওঠে, গরু-মোষের দল মনের আনন্দে তাদের আহার সারে। কিন্তু কমাস পরই ভরা বর্ষায় এ নদীই উথাল পাথাল, দুকূল ছাপিয়ে জলের ঘূর্ণি স্রোতে যা পায়, মানুষ-ঘর-বাড়ি-পশু-পাখি সব কিছুকে করাল গ্রাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় বছরই নদীর এই উৎপাতে কাছাকাছি গ্রামগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বেশিরভাগই উঠে চলে গেছে আরো উত্তরে উঁচু ডাঙা জমিতে। আর যাদের কোথাও যাওয়ার নেই এরকম পাঁচ সাতটা পরিবার নদীর সাথে কুস্তি লড়ে গাঁয়ে পড়ে রয়েছে। এরকমই দুটি পরিবারের একটির কর্তা হলো রশিদ মিয়াঁ আর আরেকটির হারাধন পাল। রশিদ মিয়াঁর তিন ছেলে আর বিবি নিয়ে সংসার, দুই মেয়ে ছিল বিয়ে হয়ে গেছে। আর হারাধন পালের দুই মেয়ে এক ছেলে। দুয়েক টুকরো জমিতে চাষ করে আর জাল বুনে এদের দিন চলে। প্রতিটি মুহূর্ত এদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, তারপর ওই রাক্ষুসি নদী বছর বছর বাড়িঘর, ফসল নষ্ট করে তাদের দিন গুজরানোর কষ্টকে কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দেয়। এত কিছুর মধ্যেও জীবন তার প্রাপ্য আদায় করতে ছাড়েনা। কারণ গরীব-বড়লোক কারোর জীবনেই তো সময় থেমে থাকেনা। তাই কালের নিয়মেই রশিদ মিয়াঁর বড় ছেলের সাথে হারাধন পালের বড় মেয়ের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা হলো। কিছুদিন লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও আস্তে আস্তে বিষয়টা গ্রামের লোকেদের চোখে পড়ে গেল। গ্রামে চার ঘর হিন্দু আর তিনঘর মুসলমানের বাস। ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পর দুই বাড়ির মধ্যে এবং গোটা গ্রামের মধ্যে চূড়ান্ত অশান্তি শুরু হল। পেটে ভাত না জুটুক ধর্মের ব্যাপারে এরা সাংঘাতিক রক্ষণশীল। পাড়ার লোকেরা সালিশির মাধ্যমে ছেলে-মেয়ে এবং তাদের বাড়ির লোকেদের সাবধান করে দিলো। কিছুদিন ভালোই চলছিল, কিন্তু ওই যে কোথায় আছে না...যার সঙ্গে যার মজে মন....সাজিদ আর রুপা কিন্তু হাল ছাড়লোনা, তারা খুব সাবধানে গোপনে দেখা করতে লাগলো। সেটাও একদিন দুই পরিবারের লোকজন জেনে ফেললো। সাজিদের বাবা ছেলের মতিগতি শোধরানোর জন্যে অনশন শুরু করলো আর হারাধন পাল মেয়েকে চেলাকাঠ দিয়ে মেরে আধমরা করে ছাড়লো। পাড়ায় জানাজানি হওয়ার ভয়ে কোনো ওষুধ পথ্যও জুটলোনা। সাজিদ ঘরে বসে ফুঁসতে লাগলো। রুপার জন্যে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে আর হারাধন পালের মুন্ডুটা ছিঁড়ে নিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো মুখ বুজে ঘরে বসে থাকতে বাধ্য করছে। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার জন্য সে বেশ বুঝতে পারছে পাশের বাড়িতে তার প্রেয়সীর উপর নির্যাতন দিনদিন বেড়ে চলেছে। কি করবে সাজিদ...! রজ্জুবদ্ধ পশুর মতো অস্ফুট আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেনা। বাড়িতে একমাত্র তার কষ্টটা বুঝতে পারছিল ছোট ভাইটা। অবশেষে একটা ক্ষীণ আশার আলো সাজিদের চোখে ভেসে উঠলো। সব কিছু প্ল্যান করে গোপনে ভাইকে দিয়ে রুপাকে একটা চিঠি পাঠালো। সেখানে যাবতীয় নির্দেশ সহকারে রুপাকে কি করতে হবে তার বর্ণনা পরিষ্কার ভাবে লেখা ছিল। সেদিন ছিল ভরা অমাবস্যার রাত। বর্ষার মুখে কদিন ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় নদী ফুঁসতে শুরু করেছে। একখানা ভাঙাচোরা সালতিতে ভরসা করে যৌবনে দ্বীপ্ত সেই শক্তিমান পুরুষটি অন্ধকার রাত্রে পাগলিনীর মতো ফুঁসতে থাকা নদী পাড়ি দেওয়ার নিমিত্তে তার ভীত-সন্ত্রস্ত ভালোবাসার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে উঠে পড়লো। শক্ত পেশীবহুল হাতে বৈঠা টেনে নিল, পাড়ি জমানোর সবল প্রতিজ্ঞা তার সারা চোখ মুখ জুড়ে। 

   

গল্প শেষ হয়ে গেলেও আমার সারা বুক জুড়ে সেই অশান্ত নদীর ঢেউ ভাঙার শব্দ। আমি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "তারপর ! তারপর ! সাজিদ-রুপার কি হলো?" আমার ব্যাকুল জিজ্ঞাসায় বাউল কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকলো। আস্তে আস্তে একতারাটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রায় ফিস ফিস করে বললো, "বাউলনির কাল থেকে খুব জ্বর, ওষুধ খেয়েছে কিন্তু জ্বর কমছেনা। দেখি গিয়ে কপালে একটু জলপটি দিই।" এই বলে টলতে টলতে এগিয়ে গেলো।

আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম সাজিদ রুপার জ্বরে ভোগা অচৈতন্য শরীরটাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে উত্তাল নদী পার হচ্ছে। 

                                                                                                                          (ক্রমশ………..)


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ