সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-১৩]

ক্লাস শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হতে চলল। পারমিতা একদিনও ক্লাস বাদ দেয়নি। এবং প্রতিদিনই সৈকতের খোঁজে ওর ডিপার্টমেন্টে গিয়েছে দেখা পায় নি। আর রুচিরার ক্লাস এখনও শুরু হয় নি। পারমিতা এখন বাসা থেকে সরাসরি ক্লাসে আসে আবার বাসায়ই চলে যায়। হলে সম্ভবত আর আসা হবে না? হলে গিয়ে রুচিরাকে খুঁজেছে কিন্তু দেখা পায় নি? সৈকতকেও কয়েকদিন হলে খুঁজে এসেছে। রুম তালাবদ্ধ অবস্থায়ই পেয়েছে সবদিন। পাশের রুমে খবর রেখে এসেছে কিন্তু তবুও সৈকতের দেখা মিলছে না। পারমিতা বুঝতে পেরেছে  সৈকত ইচ্ছে করেই এমনটি করছে। আজও যেতে হবে।কিন্তু সৈকতকে না পেলেও রুমমেট অনিককে ক্যাম্পাসে পেয়েছে  পারমিতা। ওর কাছ থেকে জানতে পায় যে, সৈকত একটু উদ্ভট প্রকৃতির জীবনযাপনে জড়িয়ে পড়েছে। সকালে বের হয় আর গভীর রাতে রুমে ফেরে। আর সবকিছুতেই নিষ্পৃহ ভাব। আগের উৎফুল্ল সৈকত আর নেই। 

অনিক বলল সকাল দশটায় মধ্যে আসলে সৈকতকে পাওয়া যাব।- এই বলে অনিক ঘড়ি দেখে বলে এখন অবশ্য গেলে পেতে পার।

পারমিতা ক্যাম্পাসে আর সময় ব্যয় করে না। রিকশা নিয়ে সোজা সৈকতের হলে। রিকশা থেকে নেমে পারমিতা খুব দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করল। কয়েকজন পেছন ফেরে পারমিতাকে লক্ষ্য করল, কিন্তু পারমিতার সেদিকে খেয়াল নেই। ওর একমাত্র লক্ষ্য এবং ভাবনা হল সৈকত। সিঁড়ি বেয়ে রীতিমতো দৌড়ে এল পারমিতা।

রুমের দরজা খোলা। সৈকত উপুড় হয়ে ঘুমুচ্ছে। একটা হাত ফ্লোর ছুঁই ছুঁই করে ঝুলে আছে। টেবিলের  উপর সিগারেটের প্যাকেট, একটা ম্যাচ এবং একটা কাঁচের ছাইদানী। ছাইদানীটায় সিগারেটের পরিত্যক্ত অংশে পুরো ঠাসাঠাসি। বইপত্রগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। টেবিলের নিচটায় অসংখ্য আবর্জনা । আর মাথার ওপরের অংশে ভেন্টিলেটারে চড়ুই পাখির বাসা ঝুলছে। সবকিছু মিলিয়ে পারমিতা সৈকতের জীবনের ছন্দপতনের আঁচ পেল। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না পারমিতার দরজাটা খোলা রয়ে গেছে। দরজাটা বন্ধ করে এল।

সৈকত ঘুমোচ্ছে। বিছানার ওপর চোখ বুলায়। বেডশিটটা খুব নোংরা হয়েছে। ঘামে ভিজে আবার শুকিয়ে তেল চিটচিটে হয়ে আছে। বালিশের কভারটাও একই অবস্থা। ঘুমন্ত সৈকতের দিকে তাকিয়েই পারমিতার মনটা খারাপ হয়ে যায়। চেয়ার টেনে পারমিতা বসে। তারপর টেবিলে বইপত্র গোছগাছ করে। হাতে লেগে ছাইদানীটা পড়ে ঝনাৎ শব্দে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সৈকত চোখ মেলে তাকায় । পারমিতাকে দেখতে পেয়ে নিষ্পৃহভাব নিয়ে উঠে বসে। তারপর বলে কখন এলে?- এই বলে আলনা থেকে জামাটা টেনে গায়ে জড়ায়।

পারমিতার উত্তর  অনেকক্ষণ হলো।

ডাকলে না কেন?

ঘুম ভাঙাতে খারাপ লাগে। তাছাড়া তুমি খুব ঘুমাচ্ছিলে।

রাত করে ঘুমিয়েছি তাই। একটু বস, হাত-মুখটা ধুয়ে  আসি।- বলে সৈকত রুম থেকে বের হয়ে যায়। তারপর হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালেতে মুছতে মুছতে পারমিতার কাছাকাছি হয়ে বসে। সরাসরি তাকাতে পারমিতার কষ্ট হচ্ছে। সৈকতের চোখ দুটো কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে আছে। চোখের কোণে জমে আছে কষ্ট কালি। চুলের ওপর যত্নশীল হাত হয়ত অনিক দিন ধরে পড়ে না। নীরবতা ভেঙে সৈকত বলে তারপর কী মনে করে?

পারমিতা কোন কথা বলে না। পলকহীন দৃষ্টি সৈকতের ওপর ফেলে গভীর হয়ে তাকায়। সৈকত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অবশ্য আড়ালে আড়ালে চকিতে চকিতে পারমিতাকে সৈকত দেখে। কপালে সিঁদুরের ছোট্ট ফোঁটা। সিঁথিতে সিঁদুর-রেখা। হাতে সোনায় বাঁধানো শাঁখা-চুড়ি। সেলোয়ার কামিজ পরলেও চেহারায় একটু অন্যরকম জৌলুস চেপে আছে, যা সৈকতের দৃষ্টিতে পড়েছে। হাতের অনামিকায় বসে থাকা আংটিটা সৈকতের দৃষ্টিকে বারবার টানে।

পারমিতা অভিযোগের সুরে বলে বিয়েতে গেলে না যে?

মন চায় নি তাই।

সৈকত তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করোনি। 

সৈকত জবাবে কোন কথা বলে না।

সৈকত, তুমি নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন? আমার ওপর রাগ করে নিজেকে শেষ করো না।

আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবনা কেন? কথা বলে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সৈকতের দৃষ্টি অন্য কোথাও।

পারমিতা অনেক চেষ্টা করে দৃষ্টিতে দৃষ্টি আটকাতে। সৈকত পারমিতার দৃষ্টিসীমা বুঝতে পেরেই আর এদিকে তাকায় না। পারমিতা নিরূপায় হয়ে বলে সৈকত তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছ না কেন?

না তাকিয়ে হাসে। সৈকত নির্বিকার। পারমিতা সৈকতের হাত টেনে মুখোমুখি বসায়। কিন্তু তবুও সৈকত পারমিতার দিকে সরাসরি তাকায় না। সৈকতের দৃষ্টিতে অভিমানকে ছাপিয়ে কষ্টগুলো পারমিতাকে দগ্ধ করছে। ব্যাকুল হয়ে পারমিতা বলে সৈকত এমনটি আমি কখনও চাই নি।

যা হবার তা হয়ে গেছে। এসব নিয়ে চিন্তা করে অনর্থক নিজের দুঃখকে বাড়িও না । তুমি এখন পরস্ত্রী এভাবে হুটহাট আমার এখানে এসো না।

তোমার আমার সম্পর্ক কী এরকম নাকি ?

ছিল না, এখন হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা নয় কি? 

আমি মানতে রাজী নই। অন্তত তোমার আমার সম্পর্ক তেমনটা হবে না।

আবেগ দিয়ে সব সম্পর্ক এক করা ঠিক নয়। তোমার এখন সংসার আছে। সুতরাং আমার চিন্তা তুমি কখনও করো না। করলে অমঙ্গল ছাড়া কখনও মঙ্গল হবে না। তুমি তোমার মত থাক আর আমাকে আমার মত থাকতে দাও।

সৈকত তুমি কী ভাবো? আমি কি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না?

বাসতে এখন তুমি অন্য জগতের বাসিন্দা।

সৈকত তুমি জেনে রাখো। যতদিন বাঁচব ততদিন তোমাকেই ভালোবাসবো। থাকবো হয়ত দূরে দূরে কিন্তু তোমার ছায়া আমার বুকে সর্বক্ষণ গেঁথে রাখব। ভালোবাসার জগতে তুমি শুধু আমার।

কিছুটা রাগত কণ্ঠে সৈকত বলে মিথ্যে কথা। আমি মানি না, বিশ্বাসও করি না। তুমি আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও। প্লিজ তুমি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। 

পারমিতা অবাক হয়। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে - সৈকত তুমি একথা বলতে পারলে? 

কেন পারব না। তুমি আমার জীবনের পুরো অধ্যায়কে তছনছ করে দিয়েছ। আমার স্বপ্নের বাগানের সূর্যোদয় কেড়ে নিয়েছ। আর কী চাও তুমি?

আমি শুধু তোমার একটু ভালোবাসা চাই।

আমার বুকে ভালোবাসা  নেই । আর যেটুকু আছে সেটুকু আমার নিজস্ব জগতের ভেতর ঘুরপাক খাবে। কারও ধরাছোঁয়ার নাগালে আনবো না।

প্লিজ সৈকত তুমি আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কথা বলছ কেন? তোমার ভালোবাসা না পেলে আমি বাঁচতে পারবো না। কেউ না বুঝুক অন্তত তুমি আমাকে বুঝবে এই আমার বিশ্বাস।

সৈকত অভিমানভরা দৃষ্টিতে পারমিতার দিকে তাকায়। কথাতেও অভিমান ঝরে পড়ে আমি তোমার সবকিছু না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমি তো একজন মানুষ। নিজস্ব একটা জগত নিশ্চয়ই থাকবে।  এবং এর পেছনে আবেগ-ভালোবাসা জড়িয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। আর না পাওয়ার একটা দুঃখ প্রত্যেকের থাকে। তুমি সুখে থেকো এতে আমি বাদ সাধবো না। শুধু আমাকে আমার মত থাকতে দাও।

পারমিতা হাত জোড় করে বলে তুমি আমাকে ক্ষমা করো সৈকত। তোমার আশীর্বাদ ছাড়া আমি বাঁচতে চাই না।

সৈকত  পারমিতার হাতে হাত রেখে বলে ছি!  পারমিতা, আমি কি তোমাকে অভিশাপ দিতে পারি?

তাহলে নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন?- পারমিতা অভিমানের কন্ঠে বলে

সৈকত আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ বসে আছে। দৃষ্টি জোড়া চড়ুই পাখির বাসায়।

তোমার ক্লাস শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ হল অথচ একদিনও যাওনি।- পারমিতা অভিযোগ করে বলে।

ইচ্ছে হয় না, যাই না।

ক্লাসগুলো অন্তত ঠিকভাবে করো।

না করতে গেলেই অনেক কথা বাড়বে এই ভেবে সৈকত বলে  হ্যাঁ করবো।

আজ ক্লাস নেই?

রুটিন জানা নেই।

তাহলে ক্যাম্পাসে চল।

একটু কাজ আছে। এখন ক্যাম্পাসে যাব না। ক্যাম্পাস হয়েই চলে যেও। সৈকত কোন কথা বলে না। উঠে গিয়ে সৈকত আলনার আড়ালে যায়। পারমিতা মিটিমিটি হাসে। আলনার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে কেডস জোড়া তুলে নেয়। ফিতা আটকাতে আটকাতে বলে তুমি আমার রুমে আর এসো না, দরকার হলে খবর দিও।

পারমিতা কোন কথা বলে না।

সিঁড়ি বেয়ে দু’জন নেমে আসে। সৈকত হালকা নাস্তা করে। পারমিতা শুধু এককাপ চা খেল। চায়ের শেষ চুমুক দিয়ে সৈকত সিগারেট ধরায়। পারমিতা শুধু তাকিয়ে থাকে। সৈকত বুঝতে পেরে দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে আপন মনে সিগারেটে দিল এক লম্বা টান।

রিকশায় বসে পারমিতা সৈকতের জন্য জায়গা ছেড়ে বলে- উঠে এসো।

সৈকত কোন কথা না বলে রিকশার হুডটা টেনে দেয়।

পারমিতা বলে- আবার কবে দেখা হচ্ছে?

দেখা হবে।- সৈকত অনির্দিষ্ট ভাবে বলে।

রিকশা চলতে শুরু করতেই সৈকত অন্য রিকশার জন্য ব্যস্ত হয়। পারমিতা পেছন ফিরে তাকয়িে থাকে।কিন্তু সৈকত একবারও তাকায় নি। সৈকতের রিকশাটা উল্টোদিকে রওনা হয়। দুজনার দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে বাড়তে দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে যায়। কষ্টের নিঃশ্বাস ফেলে পারমিতা দৃষ্টি ফিরিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।


........চলবে......

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ