সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

লাল পাহাড়ের দেশে: শেষ পর্ব

ড. গৌতম সরকার


পরের দুটো দিন যেন পাখির ডানায় ভর করে কেটে গেল। অনুচ্চ পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই পার্বত্য উপত্যকা পরতে পরতে সৌন্দর্য্য লুকিয়ে রেখেছে, আমরা একটার পর একটা পাপড়ি খুলে সেই সৌন্দর্য্যের পরাগরেণু মেখে নিলাম। শুধু পাহাড় কেন, এখানকার সহজ সরল মানুষগুলো তাদের আন্তরিক হাঁসি, আতিথেয়তা আর ভালোবাসা দিয়ে নেতারহাটকে আমাদের মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে দিল। রাজেশ আর যতীন প্রথমদিনের অন্যায় চাপা দিতে এই কদিনে আমাদের যে সেবাটা দিল, সেটা কি কোনো মূল্য দিয়ে বিচার করা সম্ভব? হোটেলের মালিকের স্ত্রী আর বাচ্ছা মেয়েটির সাথেও পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাটির সাথে সামনের খোলা মাঠে ছুটোছুটি খেলা আর তার প্রাণখোলা হাঁসি যেকোন জায়গার মাধুর্য কয়েকশ গুন বাড়িয়ে দিতে পারে। সেই আনন্দ পয়সা খরচ করে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ালে পাওয়া যাবে, কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। তাছাড়া অত বছর আগে জগতের সব কিছুই ছিল খাঁটি। মানুষের লোভ, অন্যায় তখনও সামাজিক সম্পর্ক, প্রকৃতি-পরিবেশকে সেভাবে কলুষিত করতে পারেনি। তাই আমাদের মত দুই অর্বাচীন পর্যটকের সাথে অনাবিল নেতারহাটের গাছ, পাহাড়, মানুষের সৌহার্দ্যের সমীকরণ মিলে যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তাই কটা দিন আমরা বুভুক্ষের মত পাহাড়সুন্দরীকে উলটেপালটে দেখেছি। সেই স্বাভাবিক গ্রহণ যেহেতু খুব স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, তাই সেখানে লজ্জা বা অনিচ্ছা ছিলোনা। জীবনের প্রথমভাগে এই ধরণের অভিজ্ঞতা একজন মানুষের মনের আবিলতা ধুয়ে দিয়ে তাকে ঋদ্ধ হতে সাহায্য করে। আমরা সৌভাগ্যবান, আমরা সেই অভিজ্ঞতার শরিক হতে পেরেছিলাম।


নেতারহাট শহরটির প্রাণকেন্দ্র হল, এখানকার পাবলিক আবাসিক স্কুল। এখনকার কথা জানিনা, তবে সেই সময় এই স্কুলে বিহারের (তখন ঝাড়খণ্ডের পত্তন হয়নি) যত এমএলএ, এমপি, এবং মন্ত্রীর ছেলেটা পড়ত। স্কুল কলেবরে এখন কিছুটা বাড়লেও, তখনও বেশ বড় বিল্ডিং ছিল। আর এই স্কুলের নামও ছিল খুব। বিহার বোর্ডের পরীক্ষায় এই স্কুলের ছাত্ররা বারংবার স্ট্যান্ড করেছে আর সার্বিকভাবেও ভালো ফল করেছে। নেতারহাট জায়গাটা যেহেতু ছোট, তাই আসতে যেতে স্কুলের ছাত্রদের সাথে দেখা হত। আর দেখা হলেই দাঁড়িয়ে পড়ে দুই হাত জড়ো করে 'নমস্কার' আর 'গুড মর্নিং' বা 'গুড আফটারনুন' শুনতে খুব ভালো লাগতো। এই স্কুলটি পুরোপুরি রেসিডেন্সিয়াল, ছাত্র-শিক্ষক সকলেই হোস্টেলে থাকেন। তাই ওরা আমাদের কোনো নতুন টিচার বা টিচারদের গেস্ট মনে করতো। যাই মনে করে থাকুক না কেন, ওদের এই শিষ্টাচার আমাদের অভিভূত করেছিল। কবছর আগে আরও একবার ঘুরে এলাম। স্কুলকে নিয়ে কর্মকান্ড অনেক বেড়েছে। গোটা নেতারহাট জুড়ে ছাত্রদের হোস্টেল বাড়ি (এদের ভাষায় আশ্রম), অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি তৈরি হচ্ছে। পুরোনো বিল্ডিংগুলো সারিয়ে, আবার কিছু কিছু বিল্ডিং পুরো ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি হচ্ছে। আগের মত এখনও স্কুলের অন্দরে অবাধে প্রবেশ করা যায়। ছাত্রদের মধ্যে সেই পুরোনো শিষ্টাচার এখনও আছে দেখে খুব ভালো লাগলো।

নেতারহাটের এই স্কুল একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত স্কুল। স্বাধীনতার ঠিক পরেই ১৯৫৪ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় কৃষ্ণ সিং মহাশয় এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ গর্ডন পিয়ার্স, জগদীশ চন্দ্র মাথুর এবং সচ্চিদানন্দ সিনহার উদ্যোগ আর চেষ্টায়। প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন জেমস নেপিয়ের, বর্তমান প্রিন্সিপাল মিঃ বিন্ধ্যাচল পান্ডে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদর্শ, "Aatma Dipa Viharatha" - be thy own light.

গান্ধীজির দর্শন ঐকান্তিকতার সাথে পালন করা হয়৷ স্কুলের মার্গ দর্শন হল:


“Oh Lord, I desire not kingdom nor

the heaven not even moksha. All

I desire is to remove the sufferings

from the affected beings.”


কতটা সময় যে স্কুলে আর আশেপাশে কাটাতাম তার হিসাব রাখিনি। আমরাও কদিন যেন ব্রহ্মদর্শনে আবিষ্ট হয়ে ছিলাম। 

    নেতারহাট কথাটির অর্থ ‘বাঁশের হাট’৷ ছোট্ট জায়গাটিকে ঘিরে থাকা গ্রামগুলোতে সপ্তাহে কোনো একটা দিনে হাট বসে। সেই বয়সে একটার পর একটা পাহাড় টপকাতে যেমন আকর্ষণ বোধ করতাম তেমনি পাহাড়ি হাটের মোহও কিন্তু কম ছিলনা। যেকোনো পাহাড়ি হাটে গেলে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি- সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে কি না কি পাওয়া যায়! শাক-সব্জি, মশলাপাতি, জামাকাপড় থেকে শুরু করে, জুতো, মোবাইল ফোন, এমনকি গরু-ছাগল পর্যন্ত এই হাটে বিক্রি হয়। এককোনায় একটা ছোট দোকানে অনেক নারী-পুরুষের ভিড় দেখে এগিয়ে যাই। গিয়ে দেখি ওখানে মোবাইলে গান আপলোড করা হচ্ছে, আর সেই লাইনের বেশিরভাগই মধ্যবয়সী মহিলা। খাবারের দোকান ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আমরা দিনেরবেলাটা মেলাপ্রাঙ্গনেই এটাসেটা খেয়ে কাটিয়ে দিতাম। বিকেলে শুরু হতে মুরগী লড়াই; ব্যাপারটা আমার খুব একটা পছন্দের না হলেও এই লড়াইকে ঘিরে পাহাড়ি মানুষগুলোর উৎসাহ ছিল দেখার মত। বিকেল যত সন্ধ্যের দিকে গড়াতে থাকত হাটের মেয়ে-মরদেরা আস্তে আস্তে ভিড় জমাতো মহুয়ার ঠেকে। তারপর সন্ধ্যা যত গাঢ় হয়, নেশাও তত চেপে বসে। অন্ধকারের মধ্যে গা ঘেঁষাঘেঁষি বসে তারা তাদের ভাষায় গান গেয়ে উঠতো। সেই সুরের মাদকতা কখনও অন্ধকার রাত আবার কখনোবা চাঁদের আলোর গা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ত। দস্যি হাওয়া কখনো সেই সুরকে নিয়ে লোফালুফি করতে করতে পার্বত্য উপত্যকা জুড়ে খেলতে থাকত। আমরা চোখ বন্ধ করে বসে থাকতাম। কোনো মহুয়া বা ঘরে রাখা রাম বা হুইস্কির প্রয়োজন পড়তোনা, নেতারহাট আপন মাধুরী দিয়ে আপনাকে তার রূপনেশায় মাতাল করে তুলবেই তুলবে৷

  কটাদিনের দূর্লভ সময়যাপন একসময় শেষ হয়ে এল। চলে আসার দিনে ছেলেদুটি বাচ্চাদের মত কাঁদছিল। আমাদেরও চোখ ছলছল। আর আমরা ফিরে আসবো শুনে ওপরের বাচ্ছাটা এত অভিমান করলো যে ঘরের অর্গল বন্ধ করে বসে রইল। টাকাপয়সা মিটিয়ে ফেরার গাড়িভাড়াটা রেখে যেটুকু বাঁচলো রাজেশ আর যতীনের হাতে দিয়ে এলাম। তখন আমরাও তো কাঠ বেকার, কতটুকুই বা দিতে পারলাম!

                                         ( সমাপ্ত)


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ