সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

নাঈমুর নাহিদের লেখা গল্প




ঝরে পড়া ফুল

নাঈমুর রহমান নাহিদ


সাঈদ পেশায় ফটোগ্রাফার। ছবি তোলার জন্য  রাতের নির্জন শহরটা তার বেশ প্রিয়। এই সময়টায় ফ্ল্যাডলাইটের আবছা হলদে আলোর সাথে রাতের অন্ধকারের একটা নীরব যুদ্ধ চলে। অপরূপ এক পরিবেশ তৈরি হয় তখন। এইরকম বিচিত্র দৃশ্যকে নিজের ক্যামেরায় বন্দি করতে প্রতিদিন রাতে বেরিয়ে পড়ে সাঈদ। ক্যামেরাটি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন পার্ক, উদ্যান কিংবা রাস্তার ধারে ফুটপাত দিয়ে। এই সময়টায় অনেক পথ শিশুকে দেখা যায় ফুটপাতে পাতলা চাদর গায়ে ঘুমিয়ে থাকতে। সাঈদ সেসব শিশুদের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। এই শক্ত ইটের তৈরি ফুটপাতে কি প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছে ছেলেগুলো। অথচ আমাদের নরম বিছানায় শুয়েও ঘুম আসেনা বলে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। ডিপ্রেশন নামক আধুনিক রোগে ভুগে সবাই। সত্যি কি বিচিত্র এই পৃথিবী! কি বিচিত্র মানুষ!  কি বিচিত্র মানুষের জীবনযাত্রা।


প্রতিদিনকার মত আজও সাঈদ ক্যামেরাটা গলায় ঝুলিয়ে রাতের শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। কখনো থেমে কোনো বন্ধ দোকানের সামনে জ্বলতে থাকা লাল বাল্বের গায়ে উড়তে থাকা পোকাদের ছবি তুলে। কখনো আবার  দূর থেকে আলো আধারের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সত্ত্বার ছবি তুলে। হঠাৎ ফ্ল্যাডলাইটের হলদে আলোর নিচে একটি ছেলেকে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ায় সাঈদ। বয়স আট কি নয় হবে। ছেলেটি ফুটপাতে বসে ফ্ল্যাডলাইটের আলোতে পড়ালেখা করছে। সাঈদ তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরটা চোখের সামনে এনে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলে দৃশ্যটাকে। কিন্তু তার মনের কৌতুহল তখনও মিটেনি। সে এগিয়ে যায় ছেলেটির কাছে। ছেলেটির পাশে ফুটপাতেই বসে পড়ে সাঈদ। ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

- তোমার নাম কি বাবু?

- সাহস। মাথা না তুলেই জবাব দেয় ছেলেটি।

- সাহস! বাহ, বেশ সুন্দর নাম তো। 

ছেলেটি সাঈদের কথা শুনল বলে মনে হলো না। সাঈদ আবার জিজ্ঞেস করল,

- তুমি থাকো কোথায়? 

সাহস বিরক্ত মুখে পেছনের একটি বস্তি দেখিয়ে বলে,

- ঐ বস্তিতে। 

সাঈদের উপস্থিতি তার মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা বোঝা যায়। কিন্তু সাঈদও নাছোড়বান্দা। সে সাহসের সাথে কথা বলেই ছাড়বে।

- তা তুমি এখানে বসে পড়ছ কেন? বাসায় গিয়ে পড়।

- লাইটের টাকা দিতে পারেনাই দেইখা আমগো ঘরের লাইন কাইটা দিসে। ঘরে আলো নাই। একটা কুপি আছে ঘরে ঐটা দিয়ে মায়ে রান্না করতাসে। এল্লেগা এইখানে আইসা পড়তাসি।

সাহসের কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় সাঈদ। যেখানে সভ্য ঘরের ছেলেরা সকল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পড়ালেখা থেকে রেহাই পেতে চায়। সেখানে এই ছোট্ট সাহস পড়ালেখা করার জন্য ফুটপাতে এসে বসেছে। সাঈদ আবার জিজ্ঞেস করে,

- বড় হয়ে কি হতে চাও তুমি?

- মায়ে কইসে আমারে অনেক বড় মানুষ হইতে হইব। বড় মানুষগো নাকি অনেক সম্মান। সবাই তাগোরে সালাম

 করে। আমরা গরীব বইলা আমগো কোনো সম্মান নাই।

সাহসের জবাব শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সাঈদ। আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল সে কিন্তু পেছনের বস্তি থেকে কে যেন ডেকে উঠল,

- সাহস খাইতে আয়।

- যাইগা আমি। মায়ে ডাকতাসে। 

বই খাতা সব গুটিয়ে সাহস বস্তির দিকে চলে যায়। সাঈদ ফুটপাতের উপরেই বসে থাকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাহসের চলে যাওয়ার পথে।


দুই.

ঘটনাটার বেশ কিছুদিন পর মাঝদুপুরের কাঠফাটা রোদে সাঈদ রিক্সা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সিগনালে বেশ কিছুক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে রিক্সা। আশেপাশে হাঁক ছেড়ে নানান জিনিস বিক্রি করছে হকাররা। হঠাৎ একটি ছেলেকে দেখে চোখ আটকে যায় তার। এটা তো সাহস! ওর তো এই সময় স্কুলে থাকার কথা। ও চিপস বিক্রি করছে কেন! সাহস কে ডাক দেয় সাঈদ। সাহস সাঈদের কাছে এসে বলে,

- চিপস দিমু স্যার?

- তুমি সাহস না?

- হ, আপনে কেমনে জানেন?

সাঈদকে সাহসের মনে রাখার কথা না। মনে মনে ভাবে সাঈদ।

- তোমার তো এখন  স্কুলে থাকার কথা। তুমি চিপস বিক্রি করছ কেন?

হেসে উঠে সাহস।

- মায়ে স্কুলে চার মাসের বেতন দিতে পারে নাই দেইখা আমারে স্কুল থেকে বাইর কইরা দিসে। মায়ে কইসে আমার বড় মানুষ হওয়া লাগবনা। পড়া লেখা আমগো মত গরীবগো লেগা না। চিপস দিমু স্যার?

- ওহ হ্যাঁ, দাও।


সাহস টাকা নিয়ে 'চিপস' 'চিপস' বলে হাঁক ছেড়ে চলে যায়। সাঈদ এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সাহসের দিকে। পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করে সেদিন রাতে দেখা পড়ালেখার প্রতি পূর্ণমনষ্ক সাহস আর আজকের এই পড়ালেখার উপর থেকে আস্থা উঠে যাওয়া সাহসের মধ্যে। মনে মনে ভাবে এভাবেই হয়ত প্রতিদিন টাকার অভাবে ঝরে পড়ে যায় শত শত ফুল।


 ইসলাম নগর, মাতুয়াইল, ঢাকা।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ