সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ঈদ সংখ্যা ২০২০- "প্রাইভেট কার"



জোবায়ের রাজু 

আমাদের সংসারের অভাবগুলি দিন দিন যতই বাড়তে থাকল, আশ্চর্যজনকভাবে রনি ততই বদলে যেতে থাকে। অথচ আগে সে এমন ছিল না। ওর একটা বাইকের বড় শখ। কিন্তু বাজারে ফল বেচে সংসার চালানো আমাদের চিরদিনের সংগ্রামি বাবার পক্ষে বাইক কেনার সামর্থ্য নেই। রনি সেটা বুঝতেও চায় না। একদিন সকালে ব্যর্থ বাবাকে আঙ্গুল উঠিয়ে বলে, ‘সন্তানের মনের আশা মেটাতে না পারলে বিয়ে করেছেন কেন?’ বাবা রনির এই জঘন্য প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে উঠোনের কঁাঠালতলায় বিষন্ন মুখে দঁাড়িয়ে থাকলেও মা দৌড়ে এসে রনির গালে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিয়ে ওর এই নিকৃষ্ট আচরনের এক ধরনের প্রতিবাদ করলেন। 

রনি আমার দুই বছরের বড়। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে সে ওর সঠিক দায়িত্ব পালন করতে বরাবরই ব্যর্থ হলেও আমার ধ্যান জ্ঞান জুড়ে আমাদের এই ছোট্ট সংসারকে ঠিকঠাক রাখার উপযুক্ত চিন্তা আমার মাথায় ঠিকই আছে। বাজারে পথের পাশে দঁাড়িয়ে ফলের ব্যবসা করে বাবা সংসারের হাল ধরে রেখেছেন, তাই আর্থিক অবনতির কারণে বাবা তার দুই সন্তানকে পড়ালেখা করানোর দায়িত্বের কাছে হেরে গেছেন। রনির মেধা ভালো, তাই বাবা রনিকেই শিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই নিয়ে আমার অভিযোগ নেই। রোজ সকালে বইখাতা নিয়ে রনি যায় স্কুলে আর আমি যাই বাবার সাথে বাজারে। ফল ব্যবসায় বাবাকে যাবতীয় সহায়তা করা আমার এখন অভ্যাসে গড়ালো। 

শিক্ষিত হতে গিয়ে ধনীর দুলালদের সাথে রনির সখ্যতা বাড়ে। ফলে ওদের মত আয়েসি জীবনযাপন করতে গিয়ে সে প্রথমে আর্থিক সংকটে ভোগে। ওর খরচপাতির প্রয়োজনীয় পয়সার জোগাড় দিতে বাবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল। কিন্তু রনির সেদিকে পরোয়া নেই। সামান্য ফল বিক্রি করে সংসার চালানো আমাদের পরিশ্রমি বাবার কাছে রনির চাহিদার সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকে। উন্নত শপিংমল থেকে ভালো প্যান্ট, ব্যান্ডের জুতা, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, শরীরের ফিটনেস ঠিক রাখতে জিম করার খরচের কথা শোনে বাবার মুখটা আরো বেশী বিষন্ন হতে থাকে। এইসব চাহিদার সাথে সর্বশেষ যোগ হয়েছে একটি বাইক। বাইক যে রনিকে কিনে দিতেই হবে। বাবার সেই সামর্থ্য নেই। অবুঝ রনির এসব উচ্চবিলাসি আবদারের কাছে সংসারের সুখ শান্তিগুলি ক্রমশ বলি হতে থাকে। 

ধনীর দুলালি সেতু, যার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে দুজনের সম্পর্কটা প্রেমের রসায়নের দিকে যায়। রনি স্মার্ট, সুপুরুষ, ভালো ছাত্র হয়তো এইসব গুণাবলীর কারণে সেতু আমাদের বংশ মর্যাদা ও সংসারের অভাবের দিকে বিশেষ নজর না দিয়ে প্রেমের অন্ধ মোহে পাগল হয়ে রনিকে মজনু বানিয়ে সে নিজেই লাইলি হয়ে চোখের পাতায় বুনতে শুরু করেছে ভালোবাসার রঙিন স্বপ্নজাল। সেই স্বপ্নজালের ভেতরে রনি এতটাই আটকে গেল যে সে আমাদের ত্যাগ করে সেতুকে বিয়ে করে তাদের অট্টালিকায় চলে গেল। ভাঙা ঘরে পড়ে রইলাম আমি মা আর আমাদের ফল বেচা দুঃখি বাবা। 

শুনেছি সেতুদের অট্টালিকায় রনি সুখে আছে। সেতুর ধনী বাবা রনিকে মেনে নিয়ে তাদের অট্টালিকায় জায়গা দিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আয়েসি জীবন কাটানো রনি একদিনের জন্যেও আমাদের খবর রাখা জরুরি মনে করেনি। 

২.
কোট প্যান্টে রনিতে এতটাই দারুণ লাগছে যে আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রনি আমাদের কাছে ফল কিনতে এসেছে। কমলা, আপেল, ডালিম, আঙ্গুর মেপে দিচ্ছেন বাবা। আমরা কেমন আছি, মা কেমন আছেন, রনি একবারও জানতে চায়নি। মা যে আজ তিনদিন জ্বরে পুঁড়ে বিছানায় পড়ে আছে, রনি জানেনা। ফল কিনে শ্বশুরবাড়ির দিকে যেতে যেতে রনি তিরস্কার গলায় আমাকে বলল, ‘বাবা আমাকে বাইক কিনে দেয়নি, তাতে কী! আমার শ্বশুর শিঘ্রই আমাকে প্রাইভেট কার কিনে দেবেন।’ রনির কথায় আমি আন্দোলিত হয়ে মনে মনে বলি যারা পরের ধনে পোদ্দারি দেখায়, তারা ছোটলোক। 

ঈদ চলে গেল। মা ঈদের দিন বড় অপেক্ষায় ছিলেন রনি একটিবার ফোন করবে। পুরাতন মোবাইলটা সারাক্ষণ হাতে হাতে রেখেছেন ছেলের একটি ফোনের আশায়। বেলা বয়ে গেল। রনির সেই প্রত্যাশার কল আর আসেনি। রাতে চকিতে বসে অঘোরে কঁাদলেন আমাদের গরীব মা। 

আজ ঈদের তৃতীয় দিন। বাবা আর আমি ফল দোকানে মাছি তাড়াচ্ছি। এমন সময় একটি লাল প্রাইভেট কার এসে আমাদের সামনে দঁাড়ায়। প্রাইভেট কারের গ্লাস নামিয়ে যে ছেলেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, সে রনি। আহ্লাদি গলায় বলল, ‘দেখ, এটা আমার গাড়ি। আমার শ্বশুর কিনে দিয়েছেন। এখন আর বাইকের শখ নেই। আজ আমার বন্ধু জাবেদের বাড়িতে ঈদ পূর্ণমিলনি অনুষ্ঠান। ওখানে যাই।’ বলেই রনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কালো ধেঁায়া ছেড়ে চলে যেতেই ওর গাড়ির ধাক্কা লেগে আমাদের ফল দোকানের একটি কমলা মাটিতে পড়ে গিয়ে গাড়ির চাকার তলে থেঁতলে গিয়ে টসটসে রস বেরিয়ে রাজপথের ধূলা ভিজে গেল। খুব ইচ্ছে হল ওই অমানুষের শার্টের কলার ধরে টেনে এনে বলি, ‘নিমকহারাম, যে কমলা আজ তোর শ্বশুরের দেয়া প্রাইভেট কারের চাকার তলে থেঁতলে দিয়েছিস, সেই কমলা বেচে বাবা তোকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের বদলে বানিয়ে অমানুষ।’ লাল প্রাইভেট কারটি দ্রুত চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

৩.
বিকেল বেলায় হাবিব এল আমাদের ফলদোকানে। হাবিব পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুক খুলে একটি মর্মান্তিক অ্যাক্সিডেন্টের ছবি দেখালো। যে ছেলেটি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, সে আমাদের রনি। ওর দ্রুতগামি প্রাইভেট কারকে মেরে দিয়েছে বেপরোয়া ট্রাক। চূর্ণ বিচূর্ণ প্রাইভেট কার থেকে পথচারিরা আহত রনিকে টেনে বের করে প্রাইম হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। বাবা পুরো ঘটনা শোনে চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এক্ষুনি চল হাসপাতালে। জলদি।’ 

বেডে শুয়ে আছে অজ্ঞান রনি। ওর সারা শরীর ব্যান্ডেজ করা। বাবা শিশুর মত কঁাদছেন। ডাক্তার এসে বলল, ‘জ্ঞান কখন ফিরবে বলা যায় না। সবাই দোয়া করুন।’ বাবা হাত তুলে লম্বা মোনাজাত দিয়ে অস্পষ্ট গলায় সূরা পড়তে লাগলেন। বড্ড ব্যাকুল শোনাচ্ছিল বাবার গলাটা তখন। 

আমিশাপাড়া, নোয়াখালী 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ